বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনেও এ তথ্য উঠে এসেছে। আর এ খাতকে ডুবিয়ে দিতে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যানের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। নামে-বেনামে ঋণ বের করা, বিদেশে অর্থপাচারসহ কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
ফলে ব্যাংক খাতের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নেমে গেছে শূন্যের কোঠায়, এখন যার চড়া মূল্য দিচ্ছে ব্যাংকসহ পুরো দেশের মানুষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংক খাতে পরিচালকদের ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এই ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আট বছরে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৬০ শতাংশ।
দেশে বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি ৫২টি এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংক রয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট পরিচালকের সংখ্যা ৭৬০ হলেও এ ধরনের সমঝোতাভিত্তিক বড় অঙ্কের ঋণ বিনিময় করেন শতাধিক পরিচালক, যাদের মধ্যে ডজনখানেক সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। মূলত তাদের কাছেই পুরো ব্যাংকিং সেক্টর জিম্মি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১১ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর মধ্যে শুধু একটি গ্রুপের কবজায় থাকা ব্যাংকই ছিল আটটি। ওই সব ব্যাংকে গ্রুপের মালিক নিজে, তার ছেলে, পরিবারের সদস্য বা পছন্দের ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান হিসেবে বসিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে অনেকে ব্যাংক থেকে ইচ্ছামতো ঋণ নিয়েছেন। আবার নিজেরা যোগসাজশ করে এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অন্য ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ঋণের সুদ মওকুফসহ নানা অনিয়ম করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক খাতে পরিচালকদের লুটপাট চলছে দীর্ঘদিন থেকেই।
এই লুট থামাতে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে পরিচালকদের ওপর কঠোর আইন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পেরে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে একে অন্যের ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ হাতিয়ে নিচ্ছেন। আবার যেসব পরিচালকের মাধ্যমে সুবিধা নিচ্ছেন, তাদের নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ ছাড়েও সহায়তা করছেন ব্যাংক পরিচালক। এক কথায় মিলেমিশে লুটপাটে নেমেছিলেন ব্যাংক পরিচালকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগে নিজ ব্যাংক থেকেই পরিচালকরা বেশি ঋণ নিতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারছেন না। তবে তাদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোনো বাধা নেই। ফলে পরিচালকরা এখন পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে যেমন ঋণ নিচ্ছেন, তেমনি প্রভাব খাটিয়ে নানা সুবিধাও নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিচালকরা তাদের ঋণের তথ্য গোপনে গড়ে তুলছেন বেনামি প্রতিষ্ঠান। ওই সব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রাখা হচ্ছে ব্যাংক পরিচালকের আত্মীয় বা পরিচিতজনদের। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো পরিচালক তার ড্রাইভার ও সহকারীদের নাম ব্যবহার করছেন।
তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতে নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকরা এক হাজার ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন। তবে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন দুই লাখ ৩২ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ ব্যাংক খাতে পরিচালকদের ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এসব ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণও প্রায় হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিচালকদের নামে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার ঋণ থাকলেও তাদের ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বিশেষ করে, ১৫ বছরে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বেনামে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ হিসাব করলে পরিচালকদের ঋণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৫৮টি ব্যাংকই পরিচালকদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণে ঋণ দিয়েছেন। আর নিজের ব্যাংক থেকে দুটি ব্যাংকের পরিচালক এক কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়েছেন।
নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় শীর্ষে অবস্থান করছে বেসরকারি খাতের পাঁচটি ব্যাংক। ব্যাংকটির পরিচালকরা নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় এক হাজার ২৫১ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালকদের বেআইনি ও অনৈতিক চাপে দিশাহারা ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। পরিচালকদের বেপরোয়া চাপে দুর্নীতি, অনিয়মের পরিমাণ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হওয়ায় অনেকটা বেপরোয়াভাবেই বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। নিয়োগেও চলছে নজিরবিহীন দুর্নীতি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ব্যাংকেই এখন বেনামি ঋণের ছড়াছড়ি। পরিচালকদের চাপে এমডিরা ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেসব ব্যাংক থেকে বিভিন্নভাবে ঋণ বেরিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। আমার জানা মতে, ব্যাংক কম্পানি আইনে পরিচালকদের ঋণসংক্রান্ত আইনটিতে দুর্বলতা আছে। এ জন্য তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে বিভিন্নভাবে ঋণ বের করে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে যাতে আইনের এ ধরনের অপব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’
বিভিন্ন ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যাংক পরিচালকদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা বা ঋণ দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পূবালী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটি থেকে পরিচালকরা ঋণ নিয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার। আর পঞ্চম স্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে আরো ১১টি ব্যাংক। এদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি হলেও ব্যাংক পরিচালকদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৫৭ কোটি টাকা। এসব ঋণের সিংহ ভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের। ব্যাংকটি থেকে নেওয়া পরিচালকদের ঋণের ৭১৬ কোটি টাকাই খেলাপি হয়েছে। এ ছাড়া তালিকায় আছে তিনটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোর খেলাপিদের ঋণের একটি বড় অংশই বর্তমান ও সাবেক ব্যাংক পরিচালক, তাদের স্ত্রী-পুত্র-সন্তান বা তাদের নিকটাত্মীয়দের কাছে আটকা পড়ে আছে। এসব ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও বিতরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047