শেয়ারবাজারে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ভারতীয়রা: দ্য ইকোনমিস্ট


ভারতের শেয়ারবাজারে বিপুল সংখ্যক সাধারণ বিনিয়োগকারী এখন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেনে মুনাফার আশায় বিনিয়োগ করে তারা বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়েছেন। এরই ফলস্বরূপ, অনেকে যেমন নিজের স্বপ্ন হারিয়েছেন, তেমনি কেউ কেউ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
৩৯ বছর বয়সী আইটি সিস্টেমস ম্যানেজার জগদীশ তার জীবনের একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, এটা খুব কষ্ট দেয়। এটা বিরক্তিকর। আপনি শুধু একা থাকতে চাইবেন। তিনি একটি নতুন বাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু শেয়ারবাজারে ‘জুয়াভিত্তিক’ ট্রেডিংয়ের কারণে সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে।
জগদীশ বলেন, এখন আমি শুধু দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে বিশ্বাস করি। এই দুশ্চিন্তা আর নিতে পারি না।
বাজারে ধস ও পরিসংখ্যানের ভয়ঙ্কর চিত্র
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিএসই সেনসেক্স প্রায় ১১ শতাংশ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ‘পারস্পরিক শুল্কনীতি’ বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করলেও, ভারতীয় বাজার আগে থেকেই অস্থিরতার মধ্যে ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা ফিউচারস ও অপশনস এর মতো উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ লিভারেজড ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করেছেন।
ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এসইবিআই) তথ্যে দেখা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে ফিউচারস ও অপশনস লেনদেনে ১ কোটিরও বেশি রিটেইল (খুচরা) বিনিয়োগকারী প্রায় ২১৬ কোটি ডলার হারিয়েছেন। এর মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ মুনাফা করতে পেরেছেন।
‘নতুন যুগের রোগ’, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
দিল্লির মনোরোগ চিকিৎসক ড. পঙ্কজ বর্মা বলেন, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এই ঝুঁকিপূর্ণ লাভের খপ্পরে পড়ছে। এটি এক প্রকারের আসক্তি।
মুম্বাইয়ের হিপনোটিস্ট শেখর কুন্তে বলেন, যিনি সাধারণত প্রেমে ব্যর্থ বা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অসুবিধায় থাকা তরুণদের চিকিৎসা করতেন। এখন তার কাছে এমন তরুণরা আসছেন, যারা শেয়ারবাজারে টাকা হারিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। এটা একেবারে নতুন যুগের অসুখ, একরকম গণ-উন্মাদনা।
ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এসইবিআই) কড়া পদক্ষেপ ও বাজারে তার প্রতিফলন
গত অক্টোবরে এসইবিআই কঠোর নিয়ম জারি করে। এর পরপরই ব্লুমবার্গ জানায়, অপশন মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে শেয়ারবাজারে সরাসরি অংশগ্রহণের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে নতুন। পুরনো প্রজন্ম মূলত স্বর্ণে বা নির্দিষ্ট মেয়াদী আমানতে বিনিয়োগ করতেন, যেখানে রিটার্ন কম হলেও স্থিতিশীলতা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল অ্যাপ ও ডিজিটাল মাধ্যমের সহজলভ্যতা ও উচ্চ আয় তাদের শেয়ারবাজারের দিকে আকৃষ্ট করেছে।
২০২৪ সালে, ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি রিটেইল ইনফ্লো প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১২০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়, যা তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পাশাপাশি, একটি সফল প্রচারণা অভিযানের ফলে মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ পাঁচ বছরে বেড়ে ৯৯ লাখ ৩০ লাখ ডলার থেকে ৩০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সিনিয়র অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শিনোদ সোমাসুন্দরম বলেন, ফিউচারস ও অপশনস মূলত ঝুঁকি কমানোর একটি উপায়, বাজারে পতনের সময় পোর্টফোলিও রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখন যেভাবে এগুলো ব্যবহার করছেন, তা একেবারে আগুন নিয়ে খেলার মতো।
তিনি বলেন, অল্প তথ্য ও অভিজ্ঞতাহীন মানুষগুলো মাত্র কয়েক ক্লিকে লাখ লাখ টাকা বাজি রাখছেন। এটা কোনো পরিপক্ক বিনিয়োগের লক্ষণ নয়।স্মার্টফোনের মাধ্যমে সহজ প্রবেশ ও বিজ্ঞাপনের প্রভাব
করোনা মহামারির পর স্মার্টফোন যেন ভার্চুয়াল ‘স্লট মেশিনে’ (জুয়া খেলার যন্ত্র) পরিণত হয়েছে। টিভিতে কার্ড গেম, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও বেটিং অ্যাপের বিজ্ঞাপন অব্যাহতভাবে মানুষকে প্রলুব্ধ করছে।
চেইনঅ্যানালাইসিসের মতে, ২০২৪ সালে ভারত ১৫১টি দেশের মধ্যে ক্রিপ্টো অ্যাডপশনে দ্বিতীয়বারের মতো শীর্ষস্থান দখল করে। যদিও সরকার ক্রিপ্টোকারেন্সি ও অবৈধ স্পোর্টস বেটিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে, তবে শেয়ারবাজারে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেডিংয়ের লাগাম এখনো পুরোপুরি টানা হয়নি।
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২৪ সালে সংসদে বলেন, ফিউচারস ও অপশনসে রিটেইল ট্রেডিংয়ের যেকোনো অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ভবিষ্যতে শুধু বাজারের জন্য নয়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও গৃহস্থালি অর্থনীতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।