সাত মাসে ১৪৩ কেজি সোনা জব্দ

0
র্কেবসরা

সোনা চোরাচালান থেমে নেই। বিমানবন্দরে এখনো নিয়মিত চোরাচালানের সোনা ধরা পড়ছে। আবার সীমান্তেও পাচারের সময় ধরা পড়ছে অবৈধ সোনা।

যেমন গত ১১ ফেব্রুয়ারি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ৩ কেজি ২৮৯ গ্রাম সোনাসহ এক যাত্রীকে আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী হুদাপাড়ার একটি গোয়ালঘর থেকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পরিত্যক্ত অবস্থায় ২ কেজি ৩৩৫ গ্রাম সোনা জব্দ করে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)।

দুই ঘটনায় ধরা পড়া সোনার পরিমাণ ৫ কেজি ৬২৪ গ্রাম, যার বর্তমান বাজারমূল্য ৭৭ কোটি টাকার বেশি।

সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলে চোরাচালানের সোনা ধরা কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযানের খবর পেলে বাহকেরা সোনা ফেলে পালিয়ে যান। ফলে অনেক সময় বাহককেও ধরা সম্ভব হয় না। বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সোনা চোরাচালানের আশ্রয়দাতা বদলেছে; কিন্তু চোরাচালান বন্ধ হয়নি। চোরাচালানকারীরা দেশের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সীমান্তে নজরদারির ঘাটতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে চোরাচালান অব্যাহত রেখেছেন।

বিজিবি এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হিসাবে, এই দুই সংস্থা আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে ১৪৩ কেজি অবৈধ সোনা উদ্ধার করা করেছে, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১৯৬ কোটি টাকার বেশি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে পরিমাণ সোনা চোরাচালান হয়, তার সামান্য অংশই জব্দ হয়। বিজিবি ও শুল্ক গোয়েন্দা যে সোনা জব্দ করে, তা অনেক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সোনা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য না পেলে চোরাচালানের সোনা ধরা কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযানের খবর পেলে বাহকেরা সোনা ফেলে পালিয়ে যান। ফলে অনেক সময় বাহককেও ধরা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় একটি বিওপি (সীমান্তে নজরদারির চৌকি বা বর্ডার আউটপোস্ট) থেকে অন্যটির দূরত্ব ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার। একটি বিওপিতে ২০ থেকে ৩০ জন বিজিবির সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ক্যাম্প নিরাপত্তার জন্য ১০ জন সদস্য থাকেন। অন্যরা হয়তো বাইরে যান। তবে সব সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা টহল দেওয়া খুব কঠিন। এ কারণেই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়।

দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে গত পাঁচ বছরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৭২৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে। গত পাঁচ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮৪০ কেজি সোনা জব্দ করেছে।

বছরে ৫৮২ কেজি জব্দ
সোনা চোরাচালান নতুন নয়। বহুদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা সোনা বাংলাদেশ হয়ে ভারতে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি পথ বা রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতে সোনার বিরাট বাজার রয়েছে।

২০২৩ সালের ২৩ এপ্রিল ভারতের ইকোনমিক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে বছরে আট লাখ কেজি সোনার চাহিদা রয়েছে। বছরে ৮০ থেকে ৯০ হাজার কেজি সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাধ্যমে ভারতে সোনা চোরাচালান বেশি হয়। দুই দেশকে বেছে নেওয়ার কারণ, নিরাপত্তার দুর্বলতা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতে সোনা আমদানির শুল্ক–কর বেশি। ফলে চোরাপথে সোনা–বাণিজ্য লাভজনক। ভারতে চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকা প্রতি কেজি সোনার দাম ৮ থেকে ৯ লাখ রুপি (১১-১৩ লাখ টাকা) কম পড়ে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বড় অঙ্কের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য রয়েছে। এটা বৈধ পথে হলে রাজস্ব আয় বাড়ত।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে গত পাঁচ বছরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৭২৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে। গত পাঁচ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮৪০ কেজি সোনা জব্দ করেছে। ঢাকা কাস্টমস হাউস শুধু হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত দুই বছরে ৪৩৬ কেজি সোনা জব্দ করেছে। হিসাব করে দেখা যায়, সর্বশেষ দুই বছরে এই তিন সংস্থা মিলে ১ হাজার ১৬৪ কেজি সোনা জব্দ করেছে, যা বছরে দাঁড়ায় ৫৮২ কেজি।

এই তিন সংস্থার বাইরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ স্থলবন্দর ও ঢাকার বাইরের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সোনা জব্দ করে। সে হিসাব পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে দুই উপায়ে সোনা পাচার করেন কারবারিরা। একটি হচ্ছে বৈধ পথে যাওয়া যাত্রীদের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ঘোষণা না দিয়ে অথবা মিথ্যা ঘোষণায় কৌশলে সোনা নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য উপায় হচ্ছে অবৈধ পথে পাচার। গত ৫ আগস্টের পর ভারত বাংলাদেশিদের ভিসা একেবারেই কম দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশিদের ভারতে যাওয়া একবারে সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে পাচারকারীরা থেমে নেই। তাঁরা সীমান্তের রুটগুলো ব্যবহার করছেন।

এক দশক ধরে বিজিবির হাতে ধরা পড়া চোরাচালানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত অন্তত ৮টি জেলার ৯০টির বেশি সীমান্ত পথ দিয়ে পাচারকারীরা সোনা চোরাচালান করছেন। এর মধ্যে যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহের অন্তত ৫০টি রুট রয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সোনার চাহিদা দেশে এবং দেশের বাইরেও (ভারত) রয়েছে। তা ছাড়া শোনা যায় ভারত থেকে বাংলাদেশে যে চোরাচালান হয়, এটার মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনার মাধ্যমে। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সোনা ভারতে পাচার হয়। মূলত বাংলাদেশকে সোনা চোরাচালানের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভারতে সোনা আমদানির শুল্ক–কর বেশি। ফলে চোরাপথে সোনা–বাণিজ্য লাভজনক। ভারতে চোরাচালানের মাধ্যমে ঢোকা প্রতি কেজি সোনার দাম ৮ থেকে ৯ লাখ রুপি (১১-১৩ লাখ টাকা) কম পড়ে।
হোতারা ধরা পড়ে না

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার গোয়ালঘর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা ২ কেজি ৩৩৫ গ্রাম সোনা কে রেখেছিল, তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তারও করা যায়নি। বিজিবি বলছে, সোনার বারগুলো ভারতে পাচারের জন্য রাখা হয়েছিল।

এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে দামুড়হুদা থানায় মামলা হয়। দামুড়হুদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।

অনেক ক্ষেত্রে সোনার বাহক ধরা পড়েন। তবে মূল হোতা, আশ্রয়দাতা ও অর্থ লগ্নিকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। যেমন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গা সদর এলাকায় একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ২ কোটি ৯৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা মূল্যের ১৮টি সোনার বারসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। এ ঘটনায় চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলাও হয়। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত দুই বাহক ছাড়া চক্রের কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি মো. খালেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার দুজনই বাহক। তাঁদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, সোনা চোরাচালানকারীরা অনেক কৌশল অবলম্বন করে। বাহকেরা জানতেই পারেন না, এই সোনার মালিক কে। ফলে বাহক ছাড়া কাউকে শনাক্ত করা যায় না।

চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও যশোর, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরায় গত ৫ আগস্টের পর হওয়া আটটি মামলার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, একটিতেও চক্র শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এসব মামলার বাদী বিজিবি।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সোনা ধরা পড়ার পর থানায় মামলা হয়। তদন্ত করে পুলিশ। ফলে এই বিষয় নিয়ে বিজিবির খুব বেশি বিশ্লেষণের সুযোগ নেই।

ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ৩ ডিসেম্বর সাত কেজি সোনাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা কাস্টমস হাউস। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তবে এখন পর্যন্ত চারজন বাহক ছাড়া আর কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।

বিমানবন্দর থানার আরও চারটি মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তদন্তে বাহক ছাড়া আর কাউকে শনাক্ত করা যায়নি।

বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা সোনা পাঠাচ্ছেন এবং যাঁরা এ দেশে সেটি গ্রহণ করছেন, তাঁদের বিষয়ে বাহক কোনো তথ্যই জানেন না। ফলে বাহককে ধরার পর বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।

দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সবচেয়ে বেশি চোরাচালানের সোনা জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সংস্থাটির মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সোনা চোরাচালানের মামলাগুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা দরকার।

গ্রেপ্তার দুজনই বাহক। তাঁদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার ওসি মো. খালেদুর রহমান
ক্ষতি কী

সোনা চোরাচালানকে কেন্দ্র করে অপরাধের ঘটনা ঘটছে। ভারতের কলকাতায় গত বছরের ১৩ মে ঝিনাইদহ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের পেছনেও ছিল আন্তর্দেশীয় সোনা চোরাচালান চক্রের দ্বন্দ্ব। ধারণা করা হয়, সীমান্ত দিয়ে আসা মাদকের মূল্য পরিশোধে ব্যবহার করা হয় সোনা।

চোরাচালানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ বাণিজ্যে সোনা ব্যবহার করা হয়। অবৈধ বাণিজ্য মানেই সরকারের রাজস্ব ক্ষতি। নানাভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে ক্ষতি হয় সোনা চোরাচালানের কারণে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বড় অঙ্কের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য রয়েছে। এটা বৈধ পথে হলে রাজস্ব আয় বাড়ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *