সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ মীমাংসার বৈঠক পরিচালনা করছেন চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) রূপণ কুমার দাশ। সম্প্রতি জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে
ইউনিয়ন পরিষদ ও থানা-পুলিশের কাছে ১৩ বছর ধরনা দিয়েও নানাবাড়ি থেকে মায়ের সম্পত্তি বুঝে পাননি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার আবু তৈয়ব। মিথ্যা মামলায় খাটেন জেলও। বানানো হয় ভুয়া ওয়ারিশ সনদ। মামলা পরিচালনার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তৈয়বের।
এক বাল্যবন্ধুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইডের (জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা) দ্বারস্থ হন তৈয়ব। গত বছরের শুরুতে লিগ্যাল এইডে একটি আবেদন করেন তিনি। আট দফা বৈঠক, সার্ভেয়ারের মাধ্যমে জায়গা পরিমাপ করা হয়। ২১ অক্টোবর প্রায় ৯ মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর—অলটারনেটিভ ডিসপুট রেজল্যুশন) মাধ্যমে মায়ের প্রাপ্য নাল জমি, ভিটেবাড়ি, পুকুরসহ অংশ বুঝে পান তৈয়ব। জোড়া লাগে আত্মীয়তার বন্ধনেরও। সমঝোতার পর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে মামাতো ভাই আবুল মকছুমকে জড়িয়ে ধরেন তৈয়ব। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে এত দিন তাঁদের মধ্যে বন্ধ ছিল যোগাযোগও।
আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, মামলা করার সামর্থ্যও নেই। আর করলেও এত কম সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান হতো না। বিশেষ করে জমিসংক্রান্ত মামলায় বছরের পর বছর চলে যায়। যেটা ৯ বছরেও হতো না, সেটি ৯ মাসে হয়েছে।
শুধু আবু তৈয়ব নন, তাঁর মতো অনেক অসহায় বিচারপ্রার্থীর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়। আজ সোমবার জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। এ উপলক্ষে সকাল আটটায় চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে শোভাযাত্রার পরে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে লিগ্যাল এইড চট্টগ্রাম। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘দ্বন্দ্বে কোনো আনন্দ নাই, আপস করো ভাই, লিগ্যাল এইড আছে পাশে, কোনো চিন্তা নেই’।
চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) রূপণ কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় গেলে যেখানে বছরের পর বছর চলে যায়, সেখানে মাত্র ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে মীমাংসা করা হচ্ছে দেওয়ানি (জায়গাজমি-সংক্রান্ত) অভিযোগ। অভিযোগ আসার পর গুরুত্ব বুঝে প্রথমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। এতে ফল পাওয়া না গেলে ভুক্তভোগীর পক্ষে মামলা করা হয়। এখান থেকে বিচারপ্রার্থীদের ফৌজদারি, দেওয়ানি, পারিবারিক ঝামেলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। তবে জায়গাজমি-সংক্রান্ত সমস্যা বেশি থাকায় গুরুত্ব দিয়ে এগুলো এখন সমাধানের চেষ্টা বেশি করা হচ্ছে।
লিগ্যাল এইডে যে দেওয়ানি বিষয়ে কম সময়ে সমস্যা সমাধান করা হয়, এ সম্পর্কে অনেকে জানে না বলে জানান সিনিয়র সহকারী জজ রূপণ কুমার দাশ। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে আইনি সহায়তা বাড়াতে প্রচারণা অব্যাহত আছে।
চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৫ মাসে আইনি সহায়তা পেতে মোট আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৫৩২টি। আবেদনগুলো দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক অভিযোগ-সংক্রান্ত। এর মধ্যে দেওয়ানি-সংক্রান্ত আবেদন জমা পড়ে ২৬৪টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৯৫টির।
চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্বে) এরশাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আবেদনকারীদের বেশির ভাগই নারী। স্বামী কিংবা বাবার বাড়ি থেকে সম্পত্তির হিসাব বুঝে না পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসেন তাঁরা বেশি।
আবেদন ছাড়াও অসহায় ব্যক্তিদের মামলাও পরিচালনা করছে লিগ্যাল এইড। লিগ্যাল এইড চট্টগ্রামে এ জন্য ১০০ জন আইনজীবী রয়েছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম আদালতে ১৩ হাজার ৯৩০টি মামলা পরিচালনা করছেন এসব আইনজীবী সরকারি খরচে। এর মধ্যে ফৌজদারি মামলা রয়েছে ১০ হাজার ৯৬৮টি, পারিবারিক মামলা ২ হাজার ৩৩৯ এবং দেওয়ানি ৬২৩টি।
যাঁর যত অভিযোগ
নগরের কোতোয়ালি মোড়ের অদূরে আদালত ভবন অবস্থিত। সেখানকার চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের ছয়তলায় জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় অবস্থিত। ২৩ মার্চ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার রূপণ কুমার দাশকে দেখা গেছে স্মার্ট মেডিয়েশন কক্ষে দুই পক্ষকে নিয়ে কথা বলতে। আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করছেন।
নগরের পাহাড়তলী থানার ফিরোজ শাহ এলাকার বিলকিস আক্তার তাঁর পৈতৃক ভবনে মালিকানা না পাওয়ায় গত বছরের আগস্টে লিগ্যাল এইডে আবেদন করেন। এর আগে তিনি আদালতে মামলা করেন। গত ৩০ জানুয়ারি দুই পক্ষের মধ্যে আপসের মাধ্যমে তা সমঝোতা হয়। বিলকিস আক্তার বুঝে পান ভবনে তাঁর প্রাপ্য অংশের মালিকানা।
মামলার জট কমাবে সমঝোতা
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম আদালতে দেওয়ানি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৭টি। আইনজীবীরা জানান, অধিকার–সম্পর্কিত দেওয়ানি মামলায় ছোটখাটো বিরোধেও অনেকে আদালতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে। বিচারক–সংকট, সমন জারি ও গ্রহণে দেরি, বারবার সময়ের আবেদন, ওয়ারিশদের পক্ষভুক্তি, আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়া, বিচারাধীন আদালতের প্রতি অনাস্থা এনে বিবিধ মামলা করা, ভূমি পরিমাপে কমিশন নিয়োগে দেরি, আরজি সংশোধন, বারবার আপত্তি দিয়ে সময়ক্ষেপণের কারণে ঝুলে থাকে মামলাগুলো। ৫ থেকে ৩০ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি এরকম মামলাও রয়েছে।
আদালতে মামলাজট কমাতে ছোটখাটো বিষয়ে মামলায় না গিয়ে লিগ্যাল এইডের এ সেবা মামলাজট কমাতে সহায়তা করবে বলে আশা করছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুস সাত্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক সামর্থ্য না থাকা বিচারপ্রার্থীরা যাতে বিনা খরচে আইনি সহায়তা পান, সে জন্য আইনজীবীরা ভুক্তভোগীদের লিগ্যাল এইডে পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সমাজের সচেতন মানুষ অসহায় মানুষকে লিগ্যাল এইডে আসার পরামর্শ দিতে পারেন।
সহায়তা যেখানে মিলবে
২০০০ সালে প্রথম দেশে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান’ আইন করা হয়। এই আইন অনুসারে, ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাও গঠন করা হয়। তবে জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবসহ নানা কারণে সূচনাকাল থেকে ২০০৯ সালের আগপর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। তবে এখন এই সেবা মিলছে। দেশের সব আদালতেই লিগ্যাল এইড কার্যালয় রয়েছে। সেখানে সশরীর গিয়ে সমস্যার কথা বলা যায়। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে জেলা লিগ্যাল এইডের কার্যালয়ের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়। চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের ছয়তলায় জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় অবস্থিত। নগরের বাসিন্দারা সহায়তার জন্য সেখানে যেতে পারেন। এ ছাড়া হটলাইন নম্বর ১৬৪৩০ নম্বরে যোগাযোগ করেও সহায়তা চাওয়া যাবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047