বাংলাদেশ–মিয়ানমার: সীমান্তের মাইন কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ; কেউ পঙ্গু, কেউ নিঃস্ব

0
iopjo

ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে গেছে মাইন বিস্ফোরণে। ক্ষতবিক্ষত পায়ের বাকি অংশ নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন জেলে মোহাম্মদ ফিরোজ (৪৫)। মাছ ধরে ফেরার সময় গত ৬ এপ্রিল মাইন বিস্ফোরণে আহত হন তিনি। কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের শূন্যরেখার অদূরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

ফিরোজের মতো প্রায়ই মাইন ও আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছেন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষ। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১ মে পর্যন্ত বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান এক তরুণ। বিস্ফোরণের ঘটনা বেশি ঘটেছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায়।

মাইন বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পঙ্গু হয়ে গেছেন। জীবিকা হারিয়ে অনেকেরই এখন দুর্বিষহ জীবন। চিকিৎসা ব্যয়সহ নানা খরচ সামাল দিতে হতাহতদের পরিবারও অনেকটা নিঃস্ব।

মিয়ানমারে দেশটির সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাতে ব্যাপক হারে প্রাণঘাতী ভূমিমাইন ও গোলাবারুদ ব্যবহার হচ্ছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা শুরু করে আরাকান আর্মি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে রাজ্যটির বেশির ভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির হাতে।

মূলত আরকান আর্মির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলের সদস্যদের ঠেকাতেই মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো আরাকান আর্মিও সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে ২৭১ কিলোমিটারের মতো। অভিযোগ উঠেছে, আরাকান আর্মিও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ব্যাপক হারে মাইন পুঁতে রেখেছে, যাতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। মূলত আরকান আর্মির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলের সদস্যদের ঠেকাতেই মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো আরাকান আর্মিও সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

ভূমিমাইনে বিশ্বে যেসব দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মিয়ানমার। গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু ব্যান ল্যান্ডমাইনসের (আইসিবিএল) ‘ল্যান্ডমাইন মনিটর ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভূমিমাইন ও বিস্ফোরক ধারণকারী গোলাবারুদের আঘাতে ২০২৩ সালে মিয়ানমারে এক হাজার তিনজন হতাহত হয়েছেন। একই সময়ে সিরিয়ায় হতাহত হয়েছেন ৯৩৩ জন।

১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হয়। ভূমিমাইন তৈরি, ব্যবহার ও মজুত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই চুক্তিতে। তবে যেসব দেশ এই চুক্তিতে সই করেনি, মিয়ানমার তার মধ্যে একটি।

ফিরোজ জানান, তাঁর বাড়ি থেকে অদূরেই নাফ নদী। সেই নদী পার হয়ে লালচর এলাকায় কিছু মাছের ঘের রয়েছে। এসব মাছের ঘের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে হলেও সীমান্ত এলাকার মানুষ সেখানে মাছ ধরেন। তিনিও মাছ ধরতেই গিয়েছিলেন। সেখানে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন।
‘আমার ডান পা উড়ে গেছে’

মাইন বিস্ফোরণে আহত মোহাম্মদ ফিরোজ টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আমতলী এলাকার মো. আলী আহমদের ছেলে। তিনি এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত সোমবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডান পায়ের একটি অংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাঁর। বাকি অংশের বেশির ভাগই ব্যান্ডেজে মোড়ানো। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী সাবেকুন্নাহার।

ফিরোজ জানান, তাঁর বাড়ি থেকে অদূরেই নাফ নদী। সেই নদী পার হয়ে লালচর এলাকায় কিছু মাছের ঘের রয়েছে। এসব মাছের ঘের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে হলেও সীমান্ত এলাকার মানুষ সেখানে মাছ ধরেন। তিনিও মাছ ধরতেই গিয়েছিলেন। সেখানে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন।

মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা স্মরণ করতেই তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। বলেন, ‘অনেকেই একসঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। আগে মাছ ধরে ধরে পানি বেয়ে ফিরতাম। তবে এবার খিদে বেশি লাগায় ঘেরের মাঝখানে থাকা আল ধরে হেঁটে ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ। মুহূর্তের জন্য হুঁশ হারিয়ে ফেলি। হুঁশ ফিরতেই দেখি, আমি গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি, আমার ডান পা উড়ে গেছে।’

ফিরোজ বলেন, ‘তখনো আমার কাঁধের ওপর মাছ ধরার জাল। মাছ রাখার খালুইও কাঁধে। সেখানে প্রায় সাত কেজির মতো মাছ ছিল। আমি জালটা কাঁধ থেকে ফেলে দিই, খালুইটা ধরে রাখি। ভাবি, অন্তত ঘরে ছেলে-মেয়েরা এসব মাছ খাবে। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যাই। জোরে ডাক দিই। চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে উখিয়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামে।’

২০ বছরের বেশি সময় মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছেন জানিয়ে ফিরোজ বলেন, ‘যে এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আগেও অনেকবার মাছ ধরেছি। কখনো এ রকম ঘটনার মুখে পড়তে হয়নি।’

তখনো আমার কাঁধের ওপর মাছ ধরার জাল। মাছ রাখার খালুইও কাঁধে। সেখানে প্রায় সাত কেজির মতো মাছ ছিল। আমি জালটা কাঁধ থেকে ফেলে দিই, খালুইটা ধরে রাখি। ভাবি, অন্তত ঘরে ছেলে-মেয়েরা এসব মাছ খাবে। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যাই। জোরে ডাক দিই। চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে উখিয়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামে।
ফিরোজ
বিস্ফোরণের পর থেকে সংসারের ভরণপোষণ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বলেও জানান ফিরোজ। তিনি বলেন, ৪ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী সাবেকুন্নাহারকে নিয়ে সংসার তাঁর। তাঁর আয়েই মূলত সংসারের খরচ চলত। সম্প্রতি তাঁর ১৮ বছর বয়সী বড় ছেলেটি দিনমজুর হিসেবে কাজ করে কিছুটা আয় করছে। তবে ছেলের একার আয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়।

ফিরোজ বলেন, ‘এক মাস ধরে হাসপাতালে আছি। মানুষের কাছ থেকে টাকাপয়সা সংগ্রহ করে স্ত্রী চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে কখন ছাড়া পাই, জানি না। ছাড়পত্র পেলেও অনেক দিন চিকিৎসা চালিয়ে নিতে হবে। কীভাবে যে চিকিৎসার খরচ জোগাব, আর কীভাবেই–বা সংসারের খরচ মেটাব, ভেবে কূল পাই না।’

স্বামীর খোঁজ নেই, ছেলেটারও প্রাণ গেল

সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে ১৫ বছর আগে ঘর ছাড়েন স্বামী। এরপর তাঁর আর খোঁজ নেই। এর মধ্যেই মাইন বিস্ফোরণে গত বছরের ৭ জুলাই ছেলে মো. জোবায়েরকে (১৮) হারিয়েছেন রাবেয়া খাতুন (৪৫)।

টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় সড়কের পাশে পলিথিন আর বাঁশে তৈরি একটিতে খুপরিতে থাকেন রাবেয়া। মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা হলেও অন্তত ৩০ বছর ধরে রয়েছেন বাংলাদেশে। নিহত জোবায়েরের কথা জিজ্ঞেস করতেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন। আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ছেলে জোবায়ের ছিল ঘরে। এর মধ্যেই এলাকার মানুষের সঙ্গে নাফ নদীর লালদিয়ার চরে কাঁকড়া ধরতে যায় সে। সেখানে বোমা (মাইন) ফেটে আমার ছেলেটার ডান পা উড়ে যায়। এরপর মারা গেছে।’

রাবেয়া বলেন, ‘বেলা দুইটার দিকে ঘটনা ঘটে। আমরা খবর পাই, সাড়ে তিনটার দিকে। স্থানীয় কিছু মানুষ গিয়ে ছেলেটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। বাড়ির কাছাকাছিও নাকি তার প্রাণ ছিল। বড় ভাইকে দেখে ছেলে আমার জিজ্ঞেস করে, “মা কই।” এরপরই মারা গেছে। হাসপাতাল থেকে ছুটে এসে ছেলের লাশটা দেখেছি।’

রাবেয়া জানান, তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী হামিদ হোছেন ১৫ বছর আগে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। এর পর থেকে তাঁর আর খোঁজ মেলেনি। স্বামী বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, কিছুই জানা নেই। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মোহাম্মদ আয়াজ বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে রয়েছেন। জোবায়েরের মৃত্যুর পর কেবল কিশোরী মেয়েটাকে নিয়ে খুপরিটিতে থাকেন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে গড়ে তোলা খুপরিতে থাকার জন্য প্রতি মাসে ৫০০ টাকা দিতে হয়।

ছেলের মৃত্যুর পর অভাবে দিন কাটছে জানিয়ে রাবেয়া বলেন, ‘মেয়েটা মানুষের বাসায় কাজ করে। আমিও কাজ পেলে করি, না পেলে মানুষের কাছ থেকে কিছু খুঁজে-চেয়ে নিয়ে দিন পার করতে হয়। এর চেয়ে কষ্ট করে মানুষ থাকতে পারে কি না, জানি না। অনেক কষ্টে আছি।’

আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ছেলে জোবায়ের ছিল ঘরে। এর মধ্যেই এলাকার মানুষের সঙ্গে নাফ নদীর লালদিয়ার চরে কাঁকড়া ধরতে যায় সে। সেখানে বোমা (মাইন) ফেটে আমার ছেলেটার ডান পা উড়ে যায়। এরপর মারা গেছে।

‘খেতখামার কে দেখবে, কীভাবে বাঁচব জানি না’

চলতি বছরের ২৯ মার্চ নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ইউনিয়নের চাকঢালা সীমান্তে মিয়ানমারের ৩০০ মিটার অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন আবদুস সালাম (৩৭)। মাইন বিস্ফোরণে তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি।

জানতে চাইলে সালাম বলেন, সীমান্তের শূন্যরেখার পাশে তাঁর পানের বরজ, কলাবাগানসহ নানা খেত রয়েছে; সেখানে কাজ করছিলেন। খেতে একটি বানর দেখে তা তাড়াতে গিয়ে সীমান্ত পার হয়েছিলেন। এর মধ্যেই হঠাৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর একটি পায়ের গোড়ালিসহ একটি অংশ উড়ে যায়।

সালাম বলেন, ‘হাঁটুর নিচে পায়ের একটি অংশ নেই ভাবতেই কেমন লাগে। আমি চাষি মানুষ। ঘরে পাঁচটি ছেলেমেয়ে। নিজে খেতখামার করে সংসার চালাই। এখন খেতখামার কে দেখবে, কীভাবে বাঁচব জানি না। তবু আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও তো হতে পারত। প্রাণে বেঁচে আছি, তাতেই শোকরিয়া।’

চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে জানিয়ে সালাম বলেন, ‘কিছুদিন আগে পায়ের অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন শরীরের অবস্থা কিছুটা ভালো। আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাব।’

হাঁটুর নিচে পায়ের একটি অংশ নেই ভাবতেই কেমন লাগে। আমি চাষি মানুষ। ঘরে পাঁচটি ছেলেমেয়ে। নিজে খেতখামার করে সংসার চালাই। এখন খেতখামার কে দেখবে, কীভাবে বাঁচব জানি না। তবু আমার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও তো হতে পারত। প্রাণে বেঁচে আছি, তাতেই শোকরিয়া।
আবদুস সালাম
এ বছর হতাহত যাঁরা

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়ার মধ্যবর্তী রেজু আমতলী সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে বাংলাদেশি এক কাঠুরিয়া আহত হন। তাঁর নাম মনছুর আলম (৩০)। তিনি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের তুলাতলি গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে। বিস্ফোরণে তাঁর বাঁ পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।

এ ছাড়া আহত ব্যক্তিরা হলেন ২৬ এপ্রিল মোহাম্মদ জোবায়ের (৩০), ৮ এপ্রিল মো. তৈয়বের (৩৫), ৬ এপ্রিল মোহাম্মদ ফিরোজ (৪৫), ২৯ মার্চ আবদুস সালাম (৩৭), ২৬ মার্চ মোহাম্মদ বাবু (১৮), ১৪ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (১৪), ৩ ফেব্রুয়ারি ত্বকী উদ্দিন (২০), ১ ফেব্রুয়ারি নবী হোসেন (৪৮), ২৪ জানুয়ারি পৃথক স্থানে এক দিনে চারজন— মো. রাসেল (২৪), আরিফ উল্লাহ (৩০), আয়াত উল্লাহ (২৫) ও আলী হোছেন (৩২)।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা, ফুলতলী, জারুলিয়াছড়ি, নিকোছড়ি, ভালুখাইয়া, জামগছড়ি এবং কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে শূন্যরেখা থেকে মিয়ানমারের ২০০ থেকে ৩০০ মিটার অভ্যন্তরে গিয়ে আহত হয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে একজন বুকে আঘাত পান। বাকিদের পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।

সীমান্তের কড়া নিরাপত্তা পেরিয়ে কীভাবে বাংলাদেশিরা শূন্যরেখার ওপারে যান, সে বিষয়ে জানতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করা হয়। তবে তাঁদের কেউ কল ধরেননি। জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে ১২০ কিলোমিটারের মতো। সব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নেই। বিজিবির টহল দলকে ফাঁকি দিয়ে তাই অনেকেই মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে পড়েন। তাঁরাই মাইন বিস্ফোরণে আহত হচ্ছেন।

ইউএনও মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, যাঁরা হতাহত হচ্ছেন, বেশির ভাগই চোরাকারবারি। কেউ যাতে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে জীবনঝুঁকিতে না পড়েন, সে বিষয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

যেসব কারণে হতাহতের ঘটনা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সীমান্তের দুই পাশের বাসিন্দাদের অনেকেই নানা কাজকর্মে বৈধ প্রক্রিয়া ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করেন। গাছ কাটা, গরু চরানো, কৃষিকাজ, মাছ ধরাসহ নানা কারণে মানুষ সীমান্ত পার হন। এ ছাড়া সীমান্তে পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত রয়েছেন, যাঁরা নিয়মিত সীমান্ত অতিক্রম করেন। এসব মানুষই মূলত সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছেন। বর্তমানে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের বেশির ভাগ এলাকাতেই মাইন পোঁতা রয়েছে। তবে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সঙ্গে থাকা সীমান্তে মাইন স্থাপন করা হয়েছে বেশি। সামান্য অসতর্ক হলেই মাইনের ফাঁদে হতাহত হচ্ছেন মানুষ।

জানতে চাইলে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসরুরুল হক বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে। হতাহত ব্যক্তিরা কেন এসব এলাকায় যাচ্ছেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। লোকমুখে যেটি জানা যায়, সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষ গরু চরানো, লাকড়ি সংগ্রহ, পণ্য আনাসহ নানা কারণে সীমান্ত পার হচ্ছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরিদুল আলম বলেন, সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ গরিব। তাঁদের অনেকেই চোরাচালানের জন্য ওপারে যান। কিছু মানুষ সীমান্তে দেওয়া কাঁটাতারের খুঁটি-লোহালক্কড় সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। হতাহতদের মধ্যে তাঁদের সংখ্যা বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা সবই ঘটছে সীমান্তের শূন্যরেখায়।’

বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে। হতাহত ব্যক্তিরা কেন এসব এলাকায় যাচ্ছেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। লোকমুখে যেটি জানা যায়, সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষ গরু চরানো, লাকড়ি সংগ্রহ, পণ্য আনাসহ নানা কারণে সীমান্ত পার হচ্ছেন।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসরুরুল হক
মাইন যারা পুঁতে রাখছে

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী থেকে শুরু করে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও যে ভূমিমাইনের ব্যবহার বাড়িয়েছে, তা উঠে এসেছে আইসিবিএলের ‘ল্যান্ডমাইন মনিটর ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। কিছু ছবি বিশ্লেষণ করে মিয়ানমারে মাইন তৈরির ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।

নাইক্ষ্যংছড়ির ইউপি সদস্য ফরিদুল আলম বলেন, আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় মাইন বসিয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই ঘটছে আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা মাইনে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের ঠেকাতেই আরাকান আর্মি মাইন পুঁতে রেখেছে বলে ধারণা ফরিদুল আলমের। পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া একাধিক বক্তব্যেও সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের ঘটনায় আরাকান আর্মির পুঁতে রাখা মাইনের কথা বলা হয়েছে।

সীমান্তে মাইনে যাঁরা আহত হন, তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। কারণ, চোরাকারবারিরা মাইন কোথায় আছে, কীভাবে পার হতে হবে, সে বিষয়ে জানেন। ফলে তাঁরা হতাহত হন খুবই কম। আমরা যেটি করতে পারি, সেটি হলো, প্রথমত মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব অঞ্চলে যেতে নিরুৎসাহিত করে প্রচারণা চালানো। এর বাইরে আরাকান আর্মির সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করা যায়।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম
মিয়ানমারের সিটওয়েতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম। আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে লেখালেখিও করে আসছেন তিনি। জানতে চাইলে এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণ হচ্ছে বেশি। তবে ধারণা করা যায়, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে পড়ার শঙ্কা থেকে আরাকান আর্মিও মাইন পুঁতে রাখছে। এভাবে মাইন পুঁতে রাখা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। কোথাও মাইন পুঁতে রাখা হলেও সে বিষয়ে সতর্ক করে সাইনবোর্ড টাঙাতে হয়।

এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সীমান্তে মাইনে যাঁরা আহত হন, তাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। কারণ, চোরাকারবারিরা মাইন কোথায় আছে, কীভাবে পার হতে হবে, সে বিষয়ে জানেন। ফলে তাঁরা হতাহত হন খুবই কম। আমরা যেটি করতে পারি, সেটি হলো, প্রথমত মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ এসব অঞ্চলে যেতে নিরুৎসাহিত করে প্রচারণা চালানো। এর বাইরে আরাকান আর্মির সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করা যায়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *