ডায়ালাইসিস মেশিন বিকল, ভোগান্তির সঙ্গে নিঃস্ব হচ্ছেন রোগীরা

0
কনকতকহত

খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিন বিকলের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন কিডনি রোগীরা। হাসপাতালটিতে স্থাপিত ২৮টি ডায়ালাইসিস মেশিনের মধ্যে ১৩-১৪টি দীর্ঘদিন ধরে বিকল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে দীর্ঘ হচ্ছে সেবা প্রত্যাশীদের অপেক্ষা।
জানা যায়, ওই হাসপাতালে জনবল ও রি-এজেন্ট সংকটে বন্ধ এনজিওগ্রাম ও হার্টে রিং পরানো। আউটসোসিং কর্মী সংকটে অপরিচ্ছন্নতা আর মশা উপদ্রবে বর্তমানে অতিষ্ঠ রোগীরা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের নিচতলা থেকে জরুরি বিভাগে যাওয়ার পথজুড়ে রয়েছে দুর্গন্ধ। এর পাশাপাশি মশা ও মাছির উৎপাত রোগীদের মধ্যে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। অনেক রোগী ও স্বজন বলছেন, এই হাসপাতালের ‘বিশেষায়িত’ নামটা যেন এখন কেবলই একটি তকমা। দীর্ঘ দিন বন্ধ এনজিওগ্রাম ও হার্টে রিং পরানো। প্রায়ই বন্ধ থাকে প্যাথলোজির ২-৩টা পরীক্ষা।

এ বিষয়ে অনিক নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘ডায়ালাইসিস নির্ভর রোগীদের প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার এই সেবা নিতে হয়। মেশিন অচল থাকায় অনেকে নিয়মিত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে। কেবল মেশিন বিকল নয়, সঙ্কট তৈরি হয়েছে ব্লাড লাইন সরবরাহেও।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েক দিনের মধ্যেই উচ্চমূল্যে বাইরে থেকে এসব মেশিন কিনে আনতে হতে পারে। এতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে রোগীদের জন্য। ডায়ালাইসিস যন্ত্র ছাড়া এখন বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে বহু মানুষের।

আলমগীর নামে এক রোগী জানান, তার দুই কিডনিই বিকল, সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। পরিবার জীবিকার শেষ সম্বল গবাদি পশু ও জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নিয়মিত যাতায়াতের খরচ মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে পরিবারটি।’

আরও এক কিডনি রোগী খুলনার খালিশপুরের বাসিন্দা ৩৪ বছর বয়সী আল-আমিন জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে ডায়ালাইসিস নিতে গিয়ে তার মা ও স্ত্রীর গয়না বিক্রি করতে হয়েছে। এমনকি বিক্রি করেছেন পৈত্রিক জমিও। এখন তার চিকিৎসা চলমান থাকলেও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ভরা।’

এ দিকে, হাসপাতালটিতে শুধু যন্ত্রপাতির সংকটই নয়, সার্বিক পরিবেশ এবং পরিসেবা নিয়েও উঠে এসেছে গুরুতর অভিযোগ। সিসিইউ এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটসহ একাধিক স্পর্শকাতর ওয়ার্ডে দেখা গেছে মশার ভয়াবহ উপদ্রব। রোগীদের স্বজনেরা বাধ্য হয়ে নিজেরা মশারি টানিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, মশার যন্ত্রণায় রোগী ঘুমাতে পর্যন্ত পারছেন না।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, ‘আউটসোসিংয়ের জনবলের জন্য দরপত্র আহবান করেছিলাম। একজন কন্ট্রাক্টর বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে হাইকোর্টে রিট করে। পরবর্তীতে এটা হাইকোর্টের নির্দেশনায় দরপত্র প্রক্রিয়াটি স্থগিত রয়েছে এবং সেই কেসটি চলমান আছে। যে কারণে নতুন কন্ট্রাক্টর নিয়োগ করা যাচ্ছে না এবং নতুন করে জনবল নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না।’

আরেকটা হলো স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটা প্রজেক্ট প্রোগ্রাম ছিলো সেখানে ৬১ জন আউটসোসিং কর্মচারী ছিলেন। সেই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই আউটসোসিং কর্মচারীগুলো নেই। এ জন্য এই স্বল্পতার মধ্যে আমরা আছি। আর ডায়ালাইসিসের ওখানে আমাদের ২-৩টা কোম্পানির মেশিন আছে। সবশেষ ৪-৫ বছরে নিফ্রো নামের একটি কোম্পানির মেশিন ছিলো। ওরা সার্ভিসিং ও যন্ত্রপাতি দিতো। আর অন্য দুই কোম্পানির মেশিনগুলো অনেক পুরানো। এগুলো প্রায় নষ্ট হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মেরামতের জন্য লিখি। মাঝে ৮-৯টা মেশিন ঠিক করে দিয়েছিলো। তার মধ্যে থেকে আবার ৪টা মেশিন নষ্ট। ২৮টা মেশিন ছিলো আমাদের; এর মধ্যে এখন গড়ে ১৬ থেকে ১৭টা মেশিন চালু থাকে। বাকি ১২টা মেশিনের মধ্যে ২-১টা চালু হয় আবার নষ্ট হয় এমন। এটার কারণে আমাদের ডায়ালাইসিস সেবা কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। রোগীতে সেবা পেতে সিরিয়ালটা লম্বা হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্যাথলজির রি-এজেন্ট এবার ইজিপির মাধ্যমে কেনাকাটা করেছি এবং ৫ই আগস্ট একটা পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে আমাদের সব কিছুর অনুমোদন, কাগজপত্র পেতে একটু বিলম্ব হয়েছে। আমাদের এই কেনাকাটার কার্যক্রম শুরু করতেও একটু দেরি হয়েছে। আমাদের রি-এজেন্ট ও অন্যান্য মালামাল পেতেও দেরি হয়েছে। এ কারণে সাময়িকভাবে কিছুটা সংকট আছে। ব্লাড সুগার ও ক্রিয়েটিনিন রুটিন পরীক্ষা আপাতত কয়েকদিন বন্ধ রয়েছে। দ্রুতই ১-২ দিনের মধ্যে চালু হবে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে এনজিওগ্রাম ও হাটে রিং পরানো মেশিনটা নষ্ট। এটাও মে মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সময় নিয়েছে। আমাদের মেরামত করে দেবে।’

এ দিকে মশার উপদ্রব নিয়ে তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে জানানো হয়েছে, তারা ধোঁয়া ছড়িয়েছে। তবে নিয়মিত স্প্রের অভাবে মশা আবারও বেড়ে গেছে।

২০২৩ সালে এই হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের সেশন হয়েছে ১৪ হাজার ১৯টি। আর কিডনি রোগে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৯ হাজার রোগী। অথচ এত বিশাল রোগীর চাপ সামলাতে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও পরিবেশ কোনোভাবেই প্রস্তুত নয়।’

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করা হলেও সেবার মানে কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে অভিযোগ রোগী ও তাদের স্বজনদের। বরং পরিবেশ ও সরঞ্জামের সংকট আরও গভীর হয়েছে। বিশেষায়িত তকমাধারী এই হাসপাতাল এখন নিজেই যেন এক মুমূর্ষু রোগীতে পরিণত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *