ভেনামি চিংড়ি চাষে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা, বাড়ছে পোনার চাহিদা ও উৎপাদন


১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা। হাতে নিলে পুরো তালুতে এঁটে যায়। এমন একটি চিংড়ির দাম অন্তত ১০ হাজার টাকা। সাধারণ কোনো চিংড়ি নয় এটি। বলা হচ্ছে মা ‘ভেনামি’ চিংড়ির কথা। এ ধরনের একটি মা চিংড়ি থেকেই বছরে ১০ লাখ পর্যন্ত রেণু (পোস্ট লার্ভা) উৎপাদন সম্ভব। চিংড়ির এই প্রজাতি আমাদের দেশের নয়, বিদেশ থেকে মা চিংড়ি আমদানি করে কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে ‘ভেনামি’ চিংড়ির পোনা।
সারা বিশ্বে চিংড়ির বাজারের বড় অংশই ভেনামি চিংড়ির দখলে; কিন্তু এই জাতের চিংড়ির আবাদ তেমন হতো না এই দেশে। দেশের প্রচলিত বাগদা ও গলদা চাষে রোগের সংক্রমণ অনেক বেশি। অপর দিকে ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির উৎপাদন সাধারণ চিংড়ির চেয়ে বেশি। খামারিরা জানান, ভেনামি চিংড়ি চাষে মৃত্যুঝুঁকি নেই তেমন। পোনা ছাড়ার পর দুই মাসের মাথায় পূর্ণবয়স্ক চিংড়ি বিক্রি করা যায়। বাংলাদেশি চিংড়ি খামারিদের কাছে তাই নতুন বিকল্প ভেনামি। আর সেই বিকল্পের স্বপ্ন দেখাচ্ছে কক্সবাজার। এখানকার দুটি সরকার অনুমোদিত হ্যাচারিতে উৎপন্ন হচ্ছে ভেনামি চিংড়ির পোনা। তা ছড়িয়ে পড়ছে খুলনা, সাতক্ষীরাসহ সারা দেশের খামারিদের কাছে।
মৎস্য বিভাগ ও খামারিদের তথ্যমতে, বর্তমানে কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দেশের এক লাখ ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা ( কালো) চিংড়ির চাষ হচ্ছে। বাগদা চিংড়ি চাষে মড়কসহ নানা ঝুঁকি থাকায় খামারিরা ভেনামি চিংড়ি চাষে ঝুঁকছেন। বাগদা চিংড়ি ১৫০ দিনে ৩০-৫০ গ্রাম ওজনের হয় থাকে; আর ভেনামি চিংড়ির ১১০ দিনে ৩৫-৪০ গ্রাম ওজন হয়। দেশের বাজারে এই চিংড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে প্রতি কেজি ভেনামি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকায়। আর ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের বাগদা চিংড়ি বিক্রি হয় ৭০০-৮০০ টাকায়।
সারা বিশ্বে চিংড়ির বাজারের বড় অংশই ভেনামি চিংড়ির দখলে; কিন্তু এই জাতের চিংড়ির আবাদ তেমন হতো না এই দেশে। দেশের প্রচলিত বাগদা ও গলদা চাষে রোগের সংক্রমণ অনেক বেশি। অপর দিকে ভেনামি প্রজাতির চিংড়ির তেমন রোগ হয় না। উৎপাদনও বেশি।
বঙ্গোপসাগর থেকে মা চিংড়ি ধরে এনে কক্সবাজারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ৪০টির বেশি। এর মধ্যে সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভেনামি চিংড়ির পোনা উৎপাদন করছে দুটি হ্যাচারি।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, এত দিন দেশের খুলনা অঞ্চলে সীমিত আকারে ভেনামি চিংড়ির চাষ হলেও পোনা (রেণু) আসত বিদেশ থেকে। ২০২১ সালে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ভেনামি চিংড়ি চাষে সাফল্য আসায় পরীক্ষামূলকভাবে বিদেশ থেকে মা চিংড়ি আমদানি করে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে নিরিবিলি ফিশারিজ লিমিটেড ও দেশ বাংলা হ্যাচারিকে ভেনামি পোনা উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে হ্যাচারি দুটি ভেনামির পোনা বাজারে ছাড়ে। এই পোনা দিয়ে খামারিরা চাষবাদ শুরু করে লাভবান হচ্ছেন। মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ভেনামির কার্যক্রম (উৎপাদন, বিপণন ও চাষপদ্ধতি) তদারক করে আসছে।
কেন ভেনামি চিংড়ির চাহিদা বেশি
লিটোপেনিয়াস ভাননামি বা ‘ভেনামি’ চিংড়ি মূলত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রজাতি। বিশ্বে এই চিংড়িরই চাহিদা বেশি। হ্যাচারির মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) সভাপতি লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে বাগদা চিংড়ির চাষ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মড়ক লেগে প্রায় সময়ই খামারের চিংড়ি মারা যায়। তাতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ভেনামি চিংড়ি চাষে ঝুঁকি নেই বললে চলে। আট-নয় বছর আগে দেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমোদন দেওয়া উচিত ছিল জানিয়ে লুৎফর রহমান বলেন, দুই বছর আগে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ভেনামি চিংড়ির চাষ শুরু হলেও প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা শুধু বাগদা ও গলদা চিংড়ি রপ্তানি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। সরকার ভেনামি চিংড়ির চাষ উন্মুক্ত করে দিলে চিংড়ি রপ্তানি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।’
বঙ্গোপসাগর থেকে মা চিংড়ি ধরে এনে কক্সবাজারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ৪০টির বেশি। এর মধ্যে সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভেনামি চিংড়ির পোনা উৎপাদন করছে দুটি হ্যাচারি।
ভেনামি নতুন জাতের উচ্চ উৎপাদনশীল চিংড়ি বলে জানান কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এই জাতের পোনা সহজলভ্য নয়। চাষপদ্ধতিও বাগদা চিংড়ির মতো নয়। ভেনামি উৎপাদন ও চাষাবাদে সরকারের অনুমোদন লাগে। সঠিকভাবে ভেনামি চাষ করা গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চিংড়ির উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি চিংড়ি রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
ভেনামি চিংড়ির পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি নিরিবিলির মহাব্যবস্থাপকের কাছে জানতে চাওয়া হয় মা ভেনামি চিংড়ি সম্পর্কে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, থাইল্যান্ড থেকে প্রতিটি ভেনামি মা চিংড়ি কক্সবাজারের হ্যাচারিতে পৌঁছানোর বিপরীতে খরচ হচ্ছে গড়ে ১০ হাজার টাকা। একটি মা চিংড়ি থেকে পাওয়া যায় ১০ লাখের বেশি পোনা। এর মধ্যে ৬ লাখ পোনা বিক্রি করা যায়। খুলনা, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা, পাইকগাছা, কালীগঞ্জ, বাগেরহাট ও কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক খামার ও ঘেরে ভেনামির চাষ হচ্ছে। দুটি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক কোটি পোনা খামারে সরবরাহ হচ্ছে। ভেনামি চিংড়ির চাষ উন্মুক্ত করে দিলে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির উৎপাদন ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
নিরিবিলির মহাব্যবস্থাপক আরও বলেন, সরকার অনুমোদিত কক্সবাজারের দুটি হ্যাচারির জন্য এ বছর থাইল্যান্ড থেকে কয়েক ধাপে আমদানি করা হচ্ছে ২ হাজার ভেনামি মা চিংড়ি। তা থেকে অন্তত ৬০ কোটি পোনা পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
কালোবাজারে নিম্নমানের পোনা
উখিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভেনামি পোনা উৎপাদনের জন্য নিরিবিলি ও দেশ বাংলা নামের দুটি হ্যাচারির সরকারি অনুমোদন রয়েছে। উখিয়া উপকূলে চিংড়ির পোনা উৎপাদনের ২০-২৫টি হ্যাচারি রয়েছে। দুটি ছাড়া অন্য কোনো হ্যাচারির ভেনামি পোনা উৎপাদন নিষিদ্ধ।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে বাজারে এই দুই হ্যাচারির পোনা ছাড়াও ভেনামি পোনার নামে নিম্ন মানের পোনা বিক্রি হচ্ছে। অবৈধ পন্থায় উৎপাদিত নিম্নমানের পোনায় বাজার সয়লাব হওয়ায় হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনার দাম ১০-১৫ পয়সা কমে গেছে। এতে হ্যাচারি মালিকেরা যেমন ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তেমনি খামারিরাও প্রতারিত হচ্ছেন।
‘২০২৪ সালে থাইল্যান্ড থেকে ২ হাজার মা চিংড়ি আনা হচ্ছে, যেখান থেকে ৬০ কোটির বেশি পোনা উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতি সপ্তাহে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে অন্তত ১ কোটি পোনা সরবরাহ হচ্ছে।’
সুজন বড়ুয়া, মহাব্যবস্থাপক, নিরিবিলি হ্যাচারি
১৪ মে নিরিবিলি হ্যাচারিতে গিয়ে দেখা গেছে, বিশেষ পদ্ধতিতে ভেনামি চিংড়ির পোনার উৎপাদন চলছে। থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করে আনা মা চিংড়ির আধুনিক পদ্ধতিতে লালন-পালন করা হচ্ছে। পোনা উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনে ব্যস্ত রয়েছেন ২০-২৫ কর্মী। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০০টি ভেনামি মা চিংড়ি আমদানি করা হয়। প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদিত হয় ২ কোটির বেশি। এর মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ পোনা বাজারে ছাড়া হয়। প্রতিটি পোনা বিক্রি হয় ৮০ পয়সায়। তবে নিম্নমানের পোনার কারণে তাদের পোনা বাজারজাত করতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান হ্যাচারির কর্মকর্তারা।
উখিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল হক বলেন, কক্সবাজারের একটি হ্যাচারিতে ভেনামি পোনা উৎপাদন ও বাজারজাতের খবর পেয়ে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে দুইবার অভিযান চালানো হয়েছিল। তখন ভেনামি পোনা উৎপাদনের প্রমাণ মেলেনি। এখন ভেনামি পোনা উৎপাদিত হচ্ছে কি না, অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
বাড়ছে ভেনামির চাষ
১৪ ও ১৫ মে কক্সবাজারের খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী ও টেকনাফের কয়েকটি খামার ঘুরে দেখা গেছে, চাষিরা ভেনামি চিংড়ি চাষে ব্যস্ত। ঘেরে জাল ফেললেই আটকা পড়ছে ১০-১২ গ্রাম ওজনের ভেনামি ( সাদা) চিংড়ি। খামারিরা এই চিংড়িকে বলেন ‘লইল্যা ইছা’। তরকারির সঙ্গে এই চিংড়ির ব্যবহার খুব বেশি জানিয়ে একটি খামারের ব্যবস্থাপক আরমান হোসেন বলেন, ভেনামি চিংড়ি চাষে কিছুটা বিনিয়োগ বেশি লাগলেও দুই মাসের মাথায় চিংড়ি বিক্রি করে টাকা উপার্জন করা যায়। কিন্তু বাগদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। ভেনামি চিংড়ি ৮ গ্রাম ওজন থেকে বাজারে বিক্রি সম্ভব হলেও বাগদা চিংড়ি ৩০ গ্রামের নিচে বিক্রি হয় না। কারণ, বাগদার খোলস মোটা ও শক্ত।
চকরিয়ার ইলিশিয়াতে ৩ একরের একটি খামারে ভেনামি চিংড়ি চাষ করেন রিমন চৌধুরী। পোনা ছাড়েন ৬০ হাজার। রিমন চৌধুরী বলেন, মাত্র ৬০ দিনের মাথায় খামারের ভেনামি চিংড়ি পোনার ওজন হয়েছে ১০ গ্রাম। এখন প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়।
খামারিরা বলেন, কক্সবাজারের কলাতলীতে অবৈধ পন্থায় ভেনামি চিংড়ির পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। একটি চক্র নিম্নমানের এই পোনা বাজারজাত করছে। তাতে খামারিরা প্রতারিত হচ্ছেন। ভারত থেকেও চোরাই পথে আনা হচ্ছে ভেনামির পোনা; কিন্তু এ ক্ষেত্রে মৎস্য বিভাগের তৎপরতা নেই।