বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিতে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করে। আমদানি করে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। বাণিজ্য হিস্যায় ভারতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
এরই মধ্যে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদপণ্যসহ প্রায় সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত, যা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও প্রক্রিয়াজাতখাদ্য পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চিন্তার ভাঁজ রপ্তানিকারকদের কপালে। ভারতের বেশ কিছু পণ্যের বাজার হারানোর শঙ্কায় তারা।
ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্থলবন্দর বন্ধ হওয়ায় রপ্তানিকারকদের অনেকটা পথ ঘুরে ভারতের বিভিন্ন গন্তব্যে পণ্য পাঠাতে হবে। এতে সময় লেগে যাবে ৮ থেকে ১০ দিন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি খরচ বাড়ার পাশাপাশি পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বেড়ে যাবে। ফলে চোরাচালান বাড়বে।
বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের হালচাল
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের হিস্যা অনেক বেশি। ভারত থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই নগণ্য। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশ ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছিল ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ২৭৯ বিলিয়ন ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। কিছুটা তো আমাদের ওপর প্রভাব পড়বেই। ভারতে আমরা বড় অঙ্কের পোশাক রপ্তানি করি। প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি। পণ্য পাঠাতে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে রপ্তানিকারকদের ওপর।- র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। এর পরই রপ্তানি হয় ১৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য।
আরও পড়ুন
স্থলপথে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে
ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে বাংলাদেশের সময়-খরচ বাড়বে
বড় ক্ষতি হবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে
এছাড়া ভারতে চার কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিকপণ্য, তিন কোটি ১৩ লাখ ডলারের তুলা ও তুলার সুতার ঝুট এবং ৬৫ লাখ ডলারের আসবাবপত্র রপ্তানি হয়।
স্থলবন্দর ব্যবহার করে এসব পণ্য বেশি রপ্তানি হতো। এখন স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত। ভারত স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি নিষিদ্ধ করায় এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এছাড়া ভারতের নতুন বিধিনিষেধের কারণে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ভারত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ বিলিয়ন ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮ বিলিয়ন ডলার, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে ২৩শ ৬৭ মিলিয়ন ডলারের তুলা, ৮৮৪ মিলিয়ন ডলারের মিনারেল ফুয়েল, ৫৮৮ মিলিয়ন ডলারের পশুখাদ্য, ৫ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ডলারের নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর, ৪ হাজার ৬২৯ মিলিয়ন ডলারের ভোজ্যতেল আমদানি করে।
এখন যে পথে যাবে বাংলাদেশের পণ্য
এখন থেকে শুধু ভারতের নব সেবা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে দেশটির আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারবেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন (এলসিএস) বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে ফল, ফলের স্বাদযুক্ত পানীয়, কোমলপানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিকপণ্য, সুতা, সুতার উপজাত ও আসবাব রপ্তানি করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ী শুল্ক স্টেশন বা এলসিএসের জন্যও এটি প্রযোজ্য হবে।
বেনাপোল দিয়ে যে সুতা আমদানি বন্ধ করা হয়েছে তারই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এটি করা হয়েছে। সুতা আমদানি বন্ধে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য সরকারের অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরালো করতে হবে।- বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য ভারতের সাতটি রাজ্যে পাঠাতে হবে ভিন্ন পথে। স্থলপথে পাঠাতে হলে সাতক্ষীরার ভোমরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে পাঠাতে হবে। এর অর্থ খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ে পাঠাতে হলে প্রথমে পণ্যের চালান পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতা যাবে। পরে কলকাতা থেকে সড়ক বা রেলপথে প্রায় ১২শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ওই পণ্য যেতে হবে ত্রিপুরার আগরতলায়।
অবশ্য আসামের গৌহাটি, করিমগঞ্জ কিংবা মেঘালয়ের শিলংয়ে পণ্যের চালান পাঠাতে আরও কম পথ পাড়ি দিতে হবে। এছাড়া সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর বা মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্সে নিয়ে যেতে হবে। এতে পণ্য পাঠাতে ৭ থেকে ১০ দিন লাগতে পারে। ফলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বাংলাদেশ।
অর্থনীতিবিদ ও রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। কিছুটা তো আমাদের ওপর প্রভাব পড়বেই। ভারতে আমরা বড় অঙ্কের পোশাক রপ্তানি করি। প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি। পণ্য পাঠাতে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে রপ্তানিকারকদের ওপর।’
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তারা বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গেও এ নিয়ে আলোচনার কথা ভাবছে।
এ পরিস্থিতিতে ভারতে খাদ্যপণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থলপথে পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্যত ভারতের সঙ্গে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ নৌপথে পণ্য পরিবহন বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতামূলক হবে না। খরচের পাশাপাশি সময়ের কারণে আমরা পারবো না। আবার সব জায়গায় নৌপথে পণ্য যাবেও না। বিশেষ করে সবচেয়ে বড় বাজার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সে সুযোগ নেই।’
ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ বলেন, ‘মূলত সেভেন সিস্টার্সের বাজারে ভারতের নিজস্ব পণ্যের চেয়ে বাংলাদেশের পণ্যের আধিক্য বেশি ছিল। কারণ ভারতের মূল ভূখণ্ডের কোম্পানিগুলোর চেয়ে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলো কম খরচে সেখানে পণ্য পৌঁছাতে পারতো। সে সুযোগ বন্ধ করার জন্য এই পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে। এ দেশের কোম্পানিগুলোর জন্য বড় দুঃসংবাদ এটি।’
স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেনাপোল দিয়ে যদি রপ্তানি বন্ধ হয়, ভারত যদি কাপড় আমদানি বন্ধ করে তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে আমাদের। ভারত নিজেও পোশাক উৎপাদন করে। ভারতের সঙ্গে আমরা কঠিন প্রতিযোগিতা করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। বেনাপোল দিয়ে রপ্তানি বন্ধ হলে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে যাবে। ভারতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক ভালো।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেনাপোল দিয়ে যে সুতা আমদানি বন্ধ করা হয়েছে তারই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এটি করা হয়েছে। সুতা আমদানি বন্ধে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য সরকারের অর্থনৈতিক কূটনীতিকে জোরালো করতে হবে।’
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047