নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে আপিলের রায় আজ, কী আছে জামায়াতের ভাগ্যে?

0
lkjikji

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনা সরকার। এদিকে নিবন্ধন ও প্রতীক ছাড়াই ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। অপেক্ষা কেবল প্রতীক ও নিবন্ধনের। জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির জানিয়েছিলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা একটি আপিল করেছেন, যেটি সংবিধান সংক্রান্ত গুরুতর প্রশ্নের। সেটি শুনানি শেষে রায়ের জন্য রয়েছে। আজই (রোববার) জানা যাবে কি আছে জামায়াতে ইসলামীর ভাগ্যে।

সরকার পতনের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন এবং প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দিকে তাকিয়ে ছিলেন দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষকরাও। রোববার (১ জুন) সেই অপেক্ষার অবসান ঘটবে তাদের।

নির্বাচন কমিশন এখনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সূচি চূড়ান্ত করে ঘোষণা করেনি। তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই নিজ নিজ প্রার্থীদের নিয়ে সংসদীয় আসনে প্রস্তুতি নিচ্ছে পুরোদমে। জামায়াতও পিছিয়ে নেই। দলটি এরইমধ্যে প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। কিন্তু নিবন্ধন ও নির্বাচনী প্রতীক পুনরুদ্ধার না হওয়ায় এক ধরনের আইনি অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আজই জানা যেতে পারে জামায়াত ইসলামীর নিবন্ধন ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে তাদের ভাগ্যে কী আছে?

জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে রোববার (১ জুন) রায় ঘোষণা করবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এদিন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বিচারপতির বেঞ্চে এই রায় ঘোষণা কার্যতালিকায় ১ নম্বরে রয়েছে। এ রায়কে কেন্দ্র করে জামায়াতসহ সারাদেশের মানুষের চোখ সর্বোচ্চ আদালতের দিকে।

এর আগে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পলায়নের ৯ মাস পর নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে আপিল। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন সময়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেছে। বারবার হতাশাও প্রকাশ করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। তবে, বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী দলটির শীর্ষ নেতা ও আইনজীবীরা।

আইনজীবীর মতে, সময় যা লেগেছে সবই আইনগত প্রক্রিয়ার কারণে। আর আজকে রায় ঘোষণা করা হবে, রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে ইতিবাচক রায় পাবেন বলে আশা করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। তাই আজ সুপ্রিম কোর্টের দিকে তাকিয়ে জামায়াত ইসলামী ও দলটির সমর্থকরা।

জামায়াতের গঠনতন্ত্র অসাংবিধানিক নয় বলে যুক্তি
জোরালো যুক্তিতে জামায়াতের আইনজীবীরা দাবি করছেন, দলটির গঠনতন্ত্র মোটেও সংবিধানবিরোধী নয়। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। অতীতের মতো জামায়াত সব নির্বাচনেই অংশ নিয়েছে এবং জাতীয় সংসদে তাদের ৫৫ জন নেতা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাদের মধ্যে ৫ জন নারীও ছিলেন।

প্রতীক সংক্রান্ত যুক্তির বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক কয়েক যুগ ধরে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত এবং এটি নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ দেওয়া। এটি সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ারে নেই। যদি আপিল আদালত জামায়াতের আবেদন গ্রহণ করেন, তবে নিবন্ধনসহ প্রতীক ফেরত পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

কীভাবে বাতিল হয়েছিল নিবন্ধন
২০০৯ সালে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর নেতৃত্বে ২৫ ব্যক্তি জামায়াতের নিবন্ধন বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট তিন সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়, যা ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ হয়। পরে সময়সীমা মওকুফ করে রিভিউ চেয়ে আবেদন করলে ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ সেটি মঞ্জুর করে রায় পুনরুজ্জীবিত করেন।

নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে আইনজীবীর ভিন্ন যুক্তি
প্রতীক ফিরে পাওয়ার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার বিষয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন ফিরে পেলে প্রতীকও পাবে। জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন ফিরে পাওয়ার সঙ্গে প্রতীক ফিরে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ একটাই বলে যে সুপ্রিম কোর্টের রেজ্যুলেশন আছে। এ রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়িপাল্লা ঝোলানো আছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই দাঁড়িপাল্লা জামায়াতে ইসলামীর প্রতীক। সুপ্রিম কোর্টের রেজ্যুলেশন কোনো আইনগত প্রতিনিধিত্ব করে না। এটা মতামত মাত্র। রায়ের মাধ্যমে তো প্রতীক বাদ করেনি, সুতরাং এই আপিল নিষ্পত্তি হয়ে রেজিস্ট্রেশনও মিলবে, প্রতীকও মিলবে।

দাঁড়িপাল্লা নিয়ে যেসব যুক্তি
আপিল শুনানিতে জামায়াতের দলীয় নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেতে কয়েকটি আইনি যুক্তি তুলে ধরছেন দলটির আইনজীবীরা। এ বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগে শুনানিতে আমরা বলেছি প্রতীক বরাদ্দের দায়িত্ব তো সুপ্রিম কোর্টের নয়। কোনো প্রতীক সুপ্রিম কোর্ট বরাদ্দ করতে পারেন না। প্রতীক বরাদ্দ করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রতিটি দলকে বরাদ্দ করা হয়েছে। আজ থেকে নয়, কয়েক যুগ থেকে জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত দাঁড়িপাল্লাই দলটির প্রতীক। এই প্রতীক এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যদি আমাদের আপিল অ্যালাউ হয়, আপিল বিভাগ আপিল অ্যালাউ করেন, তাহলে নিশ্চয়ই প্রতীকসহ অ্যালাউ করবেন।

শিশির মনির বলেন, একটি কথা বলা হয় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ না দিতে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভার একটি রেজ্যুলেশন আছে। রেজ্যুলেশনের কপি আমরা সংগ্রহ করেছি। পড়ে দেখেছি, রেজ্যুলেশনের মধ্যে যা আছে সেটা কোনো বিচারিক সিদ্ধান্ত নয়। এটা হলো প্রশাসনিক। ওনারা বলছেন, দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ সমীচীন নয়। কেন সমীচীন নয়, কারণ সুপ্রিম কোর্টের সামনে দাঁড়িপাল্লা ঝোলানো আছে। এ কারণে কোনো পার্টির ব্যবহার করাটা সমীচীন নয়। এটা একটা মতামত মাত্র। এর আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা সুপ্রিম কোর্টের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। হাইকোর্ট বিভাগও প্রতীকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি।

নিবন্ধন নিয়ে যুক্তিগুলো হলো
প্রথমত, সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক এবং গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো, গণতান্ত্রিক ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী অতীতে সবগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রায় সব জাতীয় সংসদেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনোভাবেই অসাংবিধানিক নয়। কারণ অ্যাসোসিয়েশন করার অধিকার, দল গঠন করার অধিকার, এটা সব ব্যক্তির আছে।

দ্বিতীয়ত, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে এমন একজন ব্যক্তির (সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, যার দলের গঠনতন্ত্র যদি বিশ্লেষণ করেন তাহলে সেখানে দেখবেন জামায়াতের গঠনতন্ত্র যে কারণে তিনি দূষিত বলছেন, তার থেকে তার নিজের দলের গঠনতন্ত্র অনেক বেশি দূষিত। তার দল অর্থাৎ তরিকত ফেডারেশনের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা আসলে কোনোভাবেই তাদের জায়গা থেকে জামায়াতের গঠনতন্ত্র চ্যালেঞ্জ করার এখতিয়ার রাখে না। কারণ উচ্চ আদালতের তিনজন বিচারপতির মধ্যে একজন বিচারপতি রায়ে উল্লেখ করেছেন, রিটকারী সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর এ ধরনের রিট করার লোকাস স্ট্যান্ডি (এখতিয়ার) নেই। তিনি জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে কথা বলতে পারেন না। কারণ তার নিজের দলের গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ।

তৃতীয়ত, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে প্রথমে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে গঠনতন্ত্রের কিছু জায়গায় সংশোধন করতে বলেছে। সংশোধন প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় নিবন্ধন বাতিলের রায় হয়েছে, তাহলে তো দলটিকে গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে দেওয়া হলো না। বরং নির্বাচন কমিশনের কাজের মধ্যে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কমিশনের কাজকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।

চতুর্থত, ১৯৯২ সালের আইনে বলা হয়েছে, যখন সংবিধান কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে অধিকার দেওয়া হয় এবং তার সঙ্গে রেস্ট্রিকশন দেওয়া হয় তাহলে সংবিধান কর্তৃক যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেটা প্রাধান্য পাবে। সংবিধানে বলা হয়েছে, সংগঠন করা, দল গঠন করা এটা একটা সাংবিধানিক অধিকার। তাই যদি হয় তাহলে কোনো এক জায়গায় যদি রেস্ট্রিকশন থেকে থাকে, সেই রেস্ট্রিকশনকে অবশ্যই স্ট্রিক্টলি দেখার সুযোগ নেই।

পঞ্চমত, এটা একটা সার্টিফায়েড আপিল। সার্টিফায়েড আপিল মানে হলো, হাইকোর্ট বিভাগ যখন মামলাটা নিষ্পত্তি করেছে, তখন হাইকোর্ট ডিভিশন নিজেই সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, এই মামলায় সংবিধানের জটিল ব্যাখ্যা জড়িত। জটিল ব্যাখ্যা জড়িত হওয়ার কারণে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরাসরি আপিল করা হবে। লিভ টু আপিল হওয়ার সুযোগ নেই। যদি তাই হয় তাহলে হাইকোর্ট ডিভিশন স্বীকার করছেন এই মামলাটি হলো এমন এক মামলা যে মামলায় সংবিধানের বিস্তর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ হাইকোর্ট নিজেই স্বীকার করেছেন এটা সুপ্রিম কোর্টে পূর্ণাঙ্গ সেটেলড হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যেহেতু পূর্ণাঙ্গভাবে সেটেলড হয়নি। কারও সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিতে হলে এভাবে তো কেড়ে নেওয়া যায় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *