প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ১৬, ২০২৫, ৪:৪৩ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ১৪, ২০২৫, ৩:৫২ এ.এম
ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সেনাপ্রধানসহ ২০ সামরিক কমান্ডার নিহত

ইরানে নজিরবিহীন বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এসব হামলায় ইরানের সেনাপ্রধানসহ অন্তত ২০ জন সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। জবাবে পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরানও। ইসরায়েল লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট নিক্ষেপ করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইরানে ইসরায়েলের অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ঠেকাতে এ অভিযান শুরু করা হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনকে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন তাঁরা। যত দিন পর্যন্ত এ হুমকি থাকবে, তত দিন অভিযান চলবে।
ইরানে হামলা শুরু হয় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে। দেশটির সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, তেহরানের বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকাসহ শহরের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। পরে তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। এদিন ইরানের কয়েক ডজন রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দাবি করেছে ইসরায়েল।
নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা এলাকার বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী মারজিয়েহ। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘কানে তালা লাগানো বিস্ফোরণের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আতঙ্কে আমাদের সড়কের বাড়িঘর থেকে বাসিন্দারা বের হয়ে আসেন। আমরা সবাই ভিত হয়ে পড়েছিলাম। এই পরিস্থিতির যদি আরও অবনতি হয়, তখন সন্তানদের নিরাপত্তার কী হবে, তা নিয়ে আমি বড় শঙ্কার মধ্যে রয়েছি।’
ইসরায়েলের হামলায় আহত এক ব্যক্তি সড়কের পাশে অপেক্ষায়। গতকাল তেহরানেরয়টার্স
বৃহস্পতিবার রাতের হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ২০০টি যুদ্ধবিমান অংশ নিয়েছিল বলে জানান দেশটির সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফিন দেফরিন। তিনি বলেন, আট শহরে শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। পরে শুক্রবার ইরানের সংবাদমাধ্যম নুরনিউজ জানায়, তেহরানের আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলি হামলায় ৭৮ জন নিহত ও ৩২৯ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জন পরমাণুবিজ্ঞানী রয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতের পর শুক্রবার সন্ধ্যায়ও ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তাবরিজ শহরসহ কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায় ইসরায়েল। এদিন ইরানের ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনার কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় বলে জানিয়েছে ইরানের বার্তা সংস্থা ফারস নিউজ। পরে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ইসরায়েলের দুটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেছে তারা।
সেনাপ্রধানসহ ২০ কর্মকর্তা নিহত
ইরানের ইসলামি রেভোল্যুশনারি গার্ড কোর জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলায় তেহরানে তাদের প্রধান কার্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে এই বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি নিহত হয়েছেন। তেহরানে আবাসিক এলাকায় হামলায় বেশ কয়েকটি শিশুও নিহত হয়েছে। এ ছাড়া হামলায় ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএন।
ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ইসলামি রেভোল্যুশনারি গার্ড কোরের বিমানবাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহও। ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি ইসরায়েলে হামলার প্রস্তুতি নিতে হাজিজাদেহ ও তাঁর শীর্ষ সহকর্মীরা একটি ভূগর্ভস্থ কমান্ড সেন্টারে বৈঠক করছিলেন। হামলায় পুরো সেন্টারটি ধ্বংস হয়ে যায়। হামলায় ইরানের অন্তত ২০ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে সূত্র।
ইরানের পাল্টা হামলা
ইসরায়েলের হামলার পর শুক্রবার রাতে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ছোড়ে ইরান। হামলায় তেল আবিবে একটি বহুতল ভবন থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এ সময় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। শোনা যায় সাইরেনের শব্দ।
পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। সেগুলো প্রতিহত করতে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজ করছে। সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। ইরানের এই হামলায় তেল আবিবে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল–জাজিরা।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের খবরের মধ্যে ইসরায়েলের তেল আবিব শহরের আকাশে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছেছবি: রয়টার্স
বৃহস্পতিবার রাতে ইসরায়েলের হামলার পরই প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পরে শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে খামেনি বলেন, ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছে। এর জন্য ইসরায়েলকে কঠিন পরিণতি মেনে নিতে হবে।
ইসরায়েলের হামলাকে ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ বলে উল্লেখ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচিও। হামলার পর জাতিসংঘের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি বলেছেন, এ হামলা যুদ্ধের ঘোষণা। এর মাধ্যমে ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে আলোচনার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধের শঙ্কায় সেনা মোতায়েন ইসরায়েলের
ইরান-ইসরায়েলের শত্রুতা বহু পুরোনো। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় দেশটির পশ্চিমপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি ইসরায়েলকে তেহরানের বন্ধু মনে করতেন। তবে এরপর ক্ষমতায় আসা শাসকেরা ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় সর্বশেষ সংঘাত শুরুর পর দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরই মধ্যে ইরানে বৃহস্পতিবার রাতের হামলার পর যুদ্ধের শঙ্কায় রয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাপ্রধান আইয়াল জামির টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, তাঁর সেনাবাহিনী ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন করছে এবং সব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে চাইবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।’
আইয়াল জামির আরও বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। ইরানি শাসকগোষ্ঠী প্রতিশোধ নিতে আমাদের ওপর হামলার চেষ্টা করবে। এ হামলার সম্ভাব্য মূল্য আমাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা হবে। আমরা এ অভিযানের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই নিচ্ছি।’
হামলার কথা আগেই জানত যুক্তরাষ্ট্র
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর দেশটিকে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করে ওয়াশিংটন। তবে শুক্রবারের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ছিল না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, এ হামলা নিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন তিনি।
যদিও মধ্যপ্রাচ্যে বড় সংঘর্ষ হতে পারে বলে বৃহস্পতিবারেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প। আগের দিন মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছু কূটনীতিককেও সরিয়ে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন দূতাবাসগুলোতে জারি করা হয় সতর্কতা। এমন উত্তেজনার মধ্যে রোববার ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে দেশটির সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। তবে ইসরায়েলের হামলার পর ওই বৈঠক বাতিল করে তেহরান।
গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করার লক্ষ্যে দেশটির সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প। শুক্রবারের হামলার পর নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে এবং একসময় পরিচিত ইরান সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে ইরানকে অবশ্যই একটি চুক্তি করতে হবে।’
সর্বোচ্চ সংযত থাকার আহ্বান জাতিসংঘের
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দীর্ঘ আট বছর ধরে যুদ্ধে জড়িয়েছিল ইরান ও ইরাক। ওই যুদ্ধের পর থেকে ইরানের ভূখণ্ডে এত বড় পরিসরে সামরিক হামলা চালানো হলো। এই হামলার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাশিয়া, চীন, জর্ডান, ওমান, কাতার ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ। এমন পরিস্থিতিতে ইরান ও ইসরায়েলকে সর্বোচ্চ সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দাও জানিয়েছেন তিনি।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047
www.gormilnews.com