ইরান-ইসরায়েল সংঘাত পাল্টাপাল্টি হামলার তীব্রতা বাড়ল


ইরান ও ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা ঘিরে আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হামলার তীব্রতা বাড়াচ্ছে দুই দেশ। ইসরায়েলে গত শনিবার রাতভর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। একই রাতে ইরানের গ্যাসক্ষেত্র ও তেল শোধনাগারে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ হামলায় ইরানের কতজন নিহত হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি।
গতকাল রোববার ছিল দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার তৃতীয় দিন। শনিবার রাতের পর রোববার দিনের বেলায়ও পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল ও ইরান। এদিন ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা জানিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র
গোষ্ঠী হুতি। চলমান সংঘাতে এই প্রথম ইরানপন্থী কোনো গোষ্ঠী যোগ দিল। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশকে শান্ত করার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ।
গতকাল রাত একটায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছিল। এ রাতেও তেহরানের নিয়াভারান, ভালিয়াসর ও হাফতে তির স্কয়ার এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইরানের পূর্বাঞ্চলে মাশহাদ বিমানবন্দরে একটি ‘রিফুয়েলিং’ উড়োজাহাজে আঘাত হানার কথা জানায় ইসরায়েলি বাহিনী। এই উড়োজাহাজগুলো আকাশে থাকা অবস্থায় অন্য উড়োজাহাজে জ্বালানি সরবরাহ করতে সক্ষম। ইরান থেকেও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা ইরানের
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ঠেকানোর কথা বলে গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশটিতে প্রথমে হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই রাতে ইসরায়েলের দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান ইরানের ‘পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র’ স্থাপনায় আঘাত হানে। শুক্র ও শনিবারও ইরানে হামলা চলে। পাল্টা জবাব দিচ্ছে তেহরানও। তবে ইসরায়েলে শনিবার রাতভর ইরান যে হামলা চালিয়েছে, তা ছিল সবচেয়ে ব্যাপক।
ইসরায়েলে শনিবার প্রথম দফায় ইরানের হামলা শুরু হয় রাত ১১টার পরপর। এ সময় ইসরায়েলের জেরুজালেম ও হাইফা শহরে বেজে ওঠে সাইরেন। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাইফায় অবস্থিত তেল শোধনাগার। পরে রাত আড়াইটার দিকে দ্বিতীয় দফায় হামলা শুরু করে ইরান। তখন তেল আবিব ও জেরুজালেমে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, শনিবার রাতে দুই দফায় ৭৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। প্রথম দফায় ছোড়া হয় ৪০টি। এতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের তামরা শহরে চারজন নিহত হন। দ্বিতীয় দফায় ছোড়া হয় ৩৫টি ক্ষেপণাস্ত্র। এর একটি আঘাত হানে তেল আবিবের কাছে বাত ইয়াম এলাকায়। এতে অন্তত ছয়জন নিহত ও প্রায় ২০০ জন আহত হন। এ ছাড়া রেহভোত শহরে আহত হয়েছেন ৪০ জন।
হামলায় রেহভোত শহরে ওয়েইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়েরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বাত ইয়াম এলাকা। হামলায় সেখানে বেশ কয়েকটি ভবন একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
ইরানের হামলার মধ্যেই গতকাল ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতি জানায়, আগের ২৪ ঘণ্টায় মধ্য ইসরায়েলের জাফা শহরে কয়েকটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তারা। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে হিজবুল্লাহ, হামাসসহ তেহরানপন্থী আরও বিভিন্ন গোষ্ঠী রয়েছে। তবে ২০ মাস ধরে চলা গাজা সংঘাতের জেরে হামাস এবং লেবানন সংঘাতের কারণে হিজবুল্লাহ সামরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর ‘আয়রন ডোম’ নামের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দিয়ে সুরক্ষিত। তবে গত তিন দিনে ইরানের হামলায় এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ্যে আসছে বলে মনে করেন দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের বিশ্লেষক মুহানাদ সেলুম। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, আয়রন ডোম সাধারণত স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে সক্ষম। তবে ইরান থেকে ক্রুজ, ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিকের মতো দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে দেখা গেছে। আর ইরান থেকে একসঙ্গে যে পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছে, তা আয়রন ডোমের প্রতিহত করার সক্ষমতার চেয়ে বেশি।

ইরানের গ্যাসক্ষেত্র ও তেল শোধনাগারে হামলা
শনিবার রাতে ইরানেও ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিমের খবরে বলা হয়, এদিন রাতে ইরানের দক্ষিণাঞ্চল বুশেহর প্রদেশে সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওই গ্যাসক্ষেত্রে আগুন ধরে যায়। এ ছাড়া তেহরানের একটি তেল শোধনাগারেও হামলা চালানো হয়। গতকালও সেখান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে।
ইসরায়েলের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের ইস্পাহান শহরে অবস্থিত দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট একটি স্থাপনা। তবে গতকাল দিনের বেলা চালানো ওই হামলায় কেউ হতাহত হননি বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক গভর্নর আকবার সালেহি। এর কিছু আগে ইরানের শিরাজ শহরের একটি ইলেকট্রনিক কারখানায় হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো এলাকা।
গতকাল ইরানের কেরমানশাহ শহরে ঘোড়ার একটি আস্তাবলেও হামলা হয়েছে। ইরানি বার্তা সংস্থা আইএসএনএর প্রাথমিক খবর অনুযায়ী, ওই হামলায় আস্তাবলে থাকা ৫০ থেকে ৬০টি ঘোড়া মারা গেছে। এদিন ইসরায়েলের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার আহমাদ আলী জানিয়েছেন, আগের ৪৮ ঘণ্টায় তাঁরা ইসরায়েলের ৪৪টি ড্রোন ও কোয়াডকপ্টার গুলি করে ভূপাতিত করেছেন।
এদিকে তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলার আগে সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ইরানের পরমাণু প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সব স্থাপনায় হামলা হবে। নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ পাওয়ার পর তেহরানের এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, ‘আমি আমার বাড়িঘর ছেড়ে যেতে পারব না, মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে পারব না। এখন তাহলে আমি কী করব?’