হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, মাদকসহ নানা ধরনের অপরাধেই বারবার এসেছে তাঁর নাম। হত্যা মামলায় ১৪ বছরের সাজা নিয়ে কারাগারেও ছিলেন। একপর্যায়ে জামিনে বেরিয়ে আসেন। ওঠাবসা শুরু করেন যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে। এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন নিজের আধিপত্য। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও এলাকায় তাঁর সেই দাপট কমেনি। এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়ান নিজস্ব বাহিনী নিয়ে।
স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় বাবাকে তুলে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন জিতু ইসলাম (৫০) নামের বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের এই নেতা। হত্যা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের পর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মোটামুটি সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে জিতু ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী ও শিববাটি এলাকার অপরাধজগতের ‘ডন’। এলাকায় প্রকাশ্য চাঁদাবাজি করতেন। অন্তত ৩০ জন ক্যাডার নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘জিতু বাহিনী’। এই বাহিনী নিয়ে মোটরসাইকেলে শহর দাপিয়ে বেড়াতেন। পুলিশের হিসাবে, দুটি হত্যা মামলাসহ ডাকাতি, চাঁদাবাজি, চুরি ও মাদক কারবারের অভিযোগে অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে জিতু ইসলামের বিরুদ্ধে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জিতু ইসলামকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নামে হত্যা মামলা করেন নিহত রিকশাচালক শাকিল মিয়ার স্ত্রী মালেকা বেগম। মামলায় আরও ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। পুলিশ জিতু ইসলাম, তাঁর দুই সহযোগী শফিকুল হাসান (২৮) ও মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে। রোববার তিন আসামিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিতু ইসলাম উঠতি বয়স থেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ সালে ফুলবাড়ী এলাকায় করতোয়া নদী থেকে বালু লুটের ব্যবসা নিয়ে বিরোধের জেরে রবিউল ইসলাম নামের এক যুবক খুন হন। সেই মামলায় জিতু ইসলাম গ্রেপ্তার হন এবং মামলার রায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়। কয়েক বছর আগে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হন জিতু। এরপর ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি রহমতুল্লাহ মনিরের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। রহমতুল্লার হাত ধরে জেলা যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও দেখা গেছে তাঁকে। চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, করতোয়ায় বালু লুটসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
৫ আগস্টের পরপরই জিতু ইসলাম বিএনপি নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। শহর বিএনপির প্রথম সারির এক নেতার আশীর্বাদে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। এরপর বিএনপি নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রাতারাতি গড়ে তোলেন অন্তত ৩০ জনের ক্যাডার বাহিনী।
দিনদুপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রিকশাচালককে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের পর এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে রীতিমতো ‘আতঙ্ক’ হয়ে উঠেছে এই ‘জিতু বাহিনী’। বাহিনীর প্রধান জিতু ইসলাম ও দুই সহযোগী গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ দিনের রিমান্ডে থাকলেও ভয়ে এলাকার কেউ এখনো মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, স্বেচ্ছাসেবক দলের নাম ভাঙিয়ে এত দিন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন জিতু ইসলাম। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। শহরের শিববাটি এলাকায় আখড়া গেড়ে বসেছিলেন তিনি। তাঁর ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাননি এলাকাবাসী।
স্থানীয় লোকজন বলেন, বাড়ি নির্মাণ, জমি কেনা থেকে ব্যবসা—সবকিছুতেই চাঁদা দিতে হতো জিতুকে। তাঁর ৩০-৩৫ জনের একটি বাহিনী আছে। মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সবাই চলাফেরা করেন। শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি দপ্তরেও চাঁদাবাজি করেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক মুদিদোকানি বলেন, জিতু তাঁর দোকান থেকে বাকি নিতেন। দুই বছরে বাকির পরিমাণ প্রায় অর্ধলাখ টাকা। একদিন টাকা চাইতে গেলে জিতু তাঁকে মারধর করেন। ভয়ে আর টাকা চাননি।
এলাকার আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, জিতু বাহিনী মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইতেন। চাঁদা না দিলে হুমকি দিতেন এবং মারধর করতেন। এলাকায় নতুন বাড়ি করতেও জিতু বাহিনীকে চাঁদা দিতে হতো। জায়গাজমি দখলেও সিদ্ধহস্ত ছিল এই বাহিনী। কিছুদিন আগে চাঁদা না দেওয়ায় এক ব্যবসায়ীর দোকানে ককটেল হামলার অভিযোগ রয়েছে জিতুর বিরুদ্ধে।
বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জিতু যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর বাহিনীর সদস্যরা কেউ শ্রমিক লীগে, কেউ যুবলীগে ছিলেন। বিএনপি নেতাদের আশীর্বাদে অন্য দল থেকে আসা জিতুর মতো অনেক সন্ত্রাসী বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনে পদ–পদবি পেয়েছেন। ত্যাগীদের বাদ দিয়ে এসব সন্ত্রাসীকে দলে পদ-পদবি দেওয়ায় বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জিতু ইসলাম হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শহরের ফুলবাড়ী ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) জোবায়েদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিমান্ডে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা জিতু ইসলাম দায় স্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে জিতু ইসলাম জানিয়েছেন, মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে শাকিল বেয়াদবি করেছিলেন। এ কারণে জিতুর ছেলেরা তাঁকে তুলে নিয়ে আসেন। বেয়াদবির জন্য মেরেছেন। প্রাণে মারতে চাননি।
এসআই জোবায়েদ খান আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জিতু ইসলাম চাঁদাবাজির কথাও স্বীকার করেছেন। বিআরটিসি থেকে নিয়মিত চাঁদা পেতেন বলেও তিনি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন। পুলিশের নথিতে তাঁর বিরুদ্ধে দুটি হত্যা, দুটি ডাকাতির চেষ্টা, চুরি, মাদক মামলাসহ ছয়-সাতটি মামলা রয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খুনের মামলায় ১৪ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত জিতু ইসলামের ওঠাবসা ছিল যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে। বগুড়া বিএনপির অনেক নেতার সঙ্গেই এত দিন তাঁর মতো সন্ত্রাসীকে দেখা গেছে। জিতু ইসলামের মতো একজন, খুনি, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারিকে দলে পদ কেন দিতে হবে? গ্রেপ্তারের পর শুধু এই সন্ত্রাসীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে দায় এড়ানো যাবে না। জিতুর মতো চিহ্নিত সন্ত্রাসীর আশ্রয়–প্রশয়দাতা কারা? বিএনপি তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, বগুড়াবাসীর কাছে সেই জবাবদিহি দলকে নিশ্চিত করতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047