বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে মাদকের বিস্তার ঘিরে। দেশে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মাদক ইয়াবার বিস্তার ঘটেছিল এ সীমান্ত হয়েই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে উচ্চ মাত্রায় আফিম চাষ হওয়ায় দেশে হেরোইনের বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হেরোইনের মূল উপাদান হলো আফিম। একসময় বিশ্বজুড়ে বিক্রি হওয়া হেরোইনের বড় উৎস ছিল আফগানিস্তান। তবে দেশটিতে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আফিম চাষ উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকে। এ সুযোগে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব–সংঘাতে লিপ্ত থাকা মিয়ানমারে উল্লেখযোগ্যভাবে আফিম চাষ বেড়ে যায়।
গত বছরের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে মিয়ানমারকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আফিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। সীমান্তবর্তী এ এলাকায় জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে আরাকান আর্মিই নিয়ন্ত্রণ করছে। সীমান্তের এ অস্থিরতাকে মাদক কারবারীরা বড় সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। ইয়াবার পাশাপাশি বাংলাদেশে হেরোইনের ব্যবসা বিস্তারের চেষ্টা করছে তারা।
মাদক নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। তবে ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিদেশি মদ, বিয়ার ও ইনজেকটিং ড্রাগ—এই ৯ ধরনের মাদকের প্রচলন বেশি। ইয়াবার বেচাকেনা সবচেয়ে বেশি। এর বাইরে আইস ও লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) মাদকও অনেকে গ্রহণ করছে। সবচেয়ে শক্তিশালী মাদক এলএসডি মূলত বিমানবন্দর হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলো থেকে আসছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট এলাকায় এ মাদক গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র।
সংশ্লিষ্ট ব৵ক্তিরা বলছেন, মাদকের বিস্তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এর উদ্ধারের হিসাব থেকে। দেশের ভেতর চোরাচালান হওয়া মাদকের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ উদ্ধার হয় বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র। গত ১৫ বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কেবল ইয়াবা বড়িই উদ্ধার করেছে ৩৮ কোটি ৭৮ লাখ ১৮ হাজার ৯৯০টি। ধারাবাহিকভাবে ইয়াবার বিস্তার বেড়েছেই। পাশাপাশি অন্য আরও কিছু মাদকের বিস্তার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ২০২৩ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এশিয়ার দেশগুলো বিবেচনায় নিলে মাদকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিয়মিত মাদকসেবীর সংখ্যা দেড় কোটির মতো। এর বাইরে আরও ৫০ লাখ অনিয়মিত মাদকসেবী আছে। এ ২ কোটি মানুষের ৯৮ শতাংশই আবার ধূমপায়ী। তাদের কেন্দ্র করে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হচ্ছে। দিনে কেবল ইয়াবা বেচাকেনা হচ্ছে দু-তিন কোটি টাকার।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় মাদকবিরোধী অভিযানেও ভাটা পড়ে। ফলে বর্তমান পরিসংখ্যান দিয়ে মাদকের প্রকৃত চিত্র নির্ণয় করা সম্ভব নয়। মাদক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ব্যস্ততা বাড়ে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তৎপরতা বাড়ায় মাদক কারবারীরাও। এ প্রবণতা থেকে বলা যায়, বর্তমানে দেশে মাদকের বিস্তার বেড়েছে।
বাংলাদেশ মাদক উৎপাদনকারী দেশ নয়। বর্তমানে দেশে প্রচলিত মাদকের বেশির ভাগই মিয়ানমার ও ভারত সীমান্ত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে পাচার করতে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তে রীতিমতো মাদকের কারখানা গড়ে উঠেছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে এসব কারখানা বন্ধে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে বললেও প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। বর্তমানে সীমান্তকেন্দ্রিক অস্থিরতা বাড়ায় মাদকের বিস্তার আরও বৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, বর্তমানে মিয়ানমারের পাশাপাশি ভারত থেকেও ইয়াবার বড় চালান আসছে। এ দুই সীমান্ত হয়ে ইয়াবার পাশাপাশি প্রাণঘাতী মাদক আইসও আসছে। আইস বা ক্রিস্টাল মেথ ইয়াবার চেয়ে অন্তত ২৫-৩০ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক। এ মাদকের প্রধান তিনটি রুট হলো—মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে কক্সবাজার, মিয়ানমার-মিজোরাম-ত্রিপুরা-বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার-মণিপুর-ত্রিপুরা-ঢাকা।
এর বাইরে অবৈধ পথে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় মদ দেশে ঢুকছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, এসব মদের অনেকগুলোই মানহীন। সম্প্রতি মদ পান করে দুটি মৃত্যুর ঘটনার কারণও এ ভেজাল মদ হতে পারে বলে ধারণা সূত্রটির।
এ ছাড়া সড়কপথে নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্ত দিয়ে আসা মাদকের চালান দেশে প্রবেশ করাতে জনপ্রিয় রুট হয়ে উঠেছে নৌপথ। বিশেষ করে সমুদ্রপথে আসা উপকূলবর্তী এলাকাগুলো হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেক নতুন মাদকদ্রব্য দেশের অন্যান্য প্রান্তের আগে এখন উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে। যেমন পটুয়াখালীসহ উপকূলবর্তী অনেক এলাকায় এখন নতুন ধরনের ইয়াবা ‘ট্রিপল নাইন’ পাওয়া যাচ্ছে। রাজধানীসহ শহর এলাকাগুলোয় এখনো ইয়াবার এ ধরনের সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র।
মাদক নিয়ে কাজ করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, পুরোনো অনেক মাদকের পাশাপাশি নতুন মাদকও দেশে ঢুকছে। আগে থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ এ অঞ্চলে প্রচলিত মাদকগুলো ধীরে ধীরে বাংলাদেশে ঢোকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আবার ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলো থেকেও মাদক আসছে। মানবদেহের ভয়াবহ ক্ষতি করা এ মাদক এখনই রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ-সাত বছর আগেও গ্রামগঞ্জের মাদক পরিস্থিতি এমন ছিল না। একদিকে মাদকের বিস্তার হচ্ছে, অপর দিকে মাদকসেবীদের জন্য বিশ্বমানের চিকিৎসা নেই, ফলোআপ নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বসহকারে নজর না দিলে ভবিষ্যতে এর বিস্তার বাড়তেই থাকবে।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047