প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ২২, ২০২৫, ১:১৫ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ২১, ২০২৫, ৩:০৭ এ.এম
স্টার্টআপে দেশীয় বিনিয়োগ মাত্র ৮%
স্টার্টআপ খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে ১০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এর আগে গত এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি প্রজ্ঞাপন জারির কথাও বলেছিলেন গভর্নর, যদিও এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি।
দেশের স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর মোট বিনিয়োগের ৯২ শতাংশই আসে বিদেশ থেকে। গত এক দশকে এই খাতে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ১২ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)। এর মধ্যে দেশীয় বিনিয়োগ মাত্র ৯৮৭ কোটি টাকা। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্সের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিনিয়োগে দেশের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বেশি নির্ভরশীল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কেবল পুঁজি দেন; তবে অভিজ্ঞতা, দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে সহায়তা দেয় না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এর ফলে স্টার্টআপগুলো উঠতি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও স্থানীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতা, বিনিয়োগ দৃষ্টিভঙ্গি ও দক্ষতার অভাবের কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) ও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরের সংখ্যাও কম। এর সঙ্গে দেশের অধিকাংশ স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা ব্যবসা পরিকল্পনা প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের কাছে তা উপস্থাপন এবং করপোরেট সুশাসনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যাপ্ত পরামর্শ পাচ্ছেন না। ফলে বেশির ভাগ উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে পারছেন না বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্স লিমিটেড ও বিডি ভেঞ্চার লিমিটেডের চেয়ারম্যান মামুন রশীদ বলেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি অনেক মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ-তরুণী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। তাঁদের অস্ত্র অভিনবত্ব, প্রযুক্তিগত দক্ষতা আর বাংলাদেশের বিকাশমান বাজার সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইকুইটি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পুঁজি দিয়ে সহায়তা করছে। তবে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের সবারই স্থানীয়ভাবে চলতি মূলধন পেতে অসুবিধা হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে দক্ষ কর্মী পেতেও। এ ক্ষেত্রে নীতিপ্রণেতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে প্রচলিত নীতি পরিবর্তন আনতে হবে।
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি মাথায় রেখেই বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করে। এই খাতে আমাদের দেশীয় বিনিয়োগের ইকোসিস্টেম এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে আরও আগ্রহী হতে হবে
আদনান ইমতিয়াজ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), সেবা ডট এক্সওয়াইজেড
লাইটক্যাসলের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে স্টার্টআপ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মাধ্যমে। দেশি-বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল মিলে এই খাতে ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল থেকে বিনিয়োগ হয়েছে ১০ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা এবং দেশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ২০৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাদের ওয়েবসাইটে যে ১০০টি বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ১২টি বিনিয়োগ এ দেশীয়। এ খাতে দেশীয় বিনিয়োগ কম হওয়ার জন্য বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত মুনাফার প্রত্যাশা, তহবিলের সীমাবদ্ধতা ও আর্থিক নীতিকে দুষছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশের অন্যতম বড় সফল স্টার্টআপ শপ আপ। এখন পর্যন্ত তারা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ পেয়েছে। তাদের বিনিয়োগের পুরোটাই বিদেশি। শপ আপের প্রধান কৌশল কর্মকর্তা শাহিন সিয়াম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই খাতের যোগ্য মানুষদের সঙ্গে আমাদের পর্যাপ্ত অর্থসহ ব্যাংক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরকার, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও অন্য অংশীজনেরা একসঙ্গে কাজ করলে এই খাতে দেশীয় বিনিয়োগ বাড়বে। এ ছাড়া আমরা অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করছি। এর ফলে দেশের বাইরে থাকা এ দেশের নাগরিকদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা যাবে।’
দেশীয় স্টার্টআপ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ডোকো ইশো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিখিত বক্তব্যে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বেশির ভাগ ভেঞ্চার ক্যাপিটালের তহবিলকাঠামো, সীমিত অংশীদার (লিমিটেড পার্টনার) ও সাধারণ অংশীদার (জেনারেল পার্টনার) মডেল এবং ঝুঁকি মূল্যায়নের সঠিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ করে। অন্যদিকে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও দ্রুত মুনাফার আশা করেন।
আরেক দেশীয় প্রতিষ্ঠান সেবা ডট এক্সওয়াইজেড গত ১০ বছরে ১২০ কোটি টাকার বিনিয়োগ তুলেছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ বিনিয়োগই অবশ্য দেশীয়। এখন পর্যন্ত দেশীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আদনান ইমতিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিষয়টি মাথায় রেখেই বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ করে। এই খাতে আমাদের দেশীয় বিনিয়োগের ইকোসিস্টেম এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের ব্যাংক ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে আরও আগ্রহী হতে হবে। এর পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে সফল উদ্যোগের সংখ্যাও আরও বাড়াতে হবে।
স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের সবারই স্থানীয়ভাবে চলতি মূলধন পেতে অসুবিধা হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে দক্ষ কর্মী পেতেও। এ ক্ষেত্রে নীতিপ্রণেতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে প্রচলিত নীতি পরিবর্তন আনতে হবে
মামুন রশীদ, চেয়ারম্যান, ফিন্যান্সিয়াল এক্সিলেন্স লি. ও বিডি ভেঞ্চার লি.
এ ছাড়া গ্লোবাল এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীদের (ভিসি) মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, নতুন স্টার্টআপ মূল্যায়নের দুর্বলতা এবং বিনিয়োগের দিকনির্দেশনার অভাব, এ তিনটি বিষয় এখনো বড় বাধা হয়ে আছে। ফলে অনেকেই এখনো স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন না। দেশের বিনিয়োগকারীরা দৃশ্যমান সম্পদে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ কত দ্রুত বড় পরিসরে পৌঁছাতে পারে, সেই সম্ভাবনা অনেকেই বুঝতে পারেন না বলেও এই খাতে বিনিয়োগ কম বলে জানান স্টার্টআপ খাতের উদ্যোক্তারা।
বিনিয়োগে বড় বাধাগুলো
ভেঞ্চার ক্যাপিটালগুলোর বিনিয়োগে একটি কার্যকর কৌশল হলো প্রাথমিক পর্যায়ের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের মোট অর্থের ৫ শতাংশ বিনিয়োগ। এই সীমিত বিনিয়োগ বরাদ্দের মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১২টি ভিন্ন ধরনের স্টার্টআপে বিনিয়োগ করা উচিত। ফলে একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হলেও একটি সফল স্টার্টআপের লাভ অন্যান্য ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে। এই কৌশল ‘পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফিকেশন’ নামে পরিচিত।
ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান অ্যাঙ্করলেস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাহাত আহমেদ বলেন, দেশের ভেঞ্চার ক্যাপিটালগুলোর বিনিয়োগের আগ্রহ কম থাকার কারণ বিনিয়োগকাঠামো ও নীতির যথেষ্ট আধুনিকায়ন না হওয়া। আমাদের দেশের অর্থ ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক শিক্ষার পাঠ্যক্রম এখনো সময়োপযোগী হয়ে ওঠেনি। তাই আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক তৈরি হচ্ছে না। তাই বিনিয়োগে দেশীয় ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো স্টার্টআপের মতো প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে কম আগ্রহী।
বেশির ভাগ স্টার্টআপ ব্যর্থ হয় এবং এটিই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান কনস্টিলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান ও স্টার্টআপ বাংলাদেশের স্বতন্ত্র পরিচালক তানভীর আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে দেশের বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত ধারণা নেই। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এক-দুটি স্টার্টআপে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেন। পরে যখন বিনিয়োগের অভিজ্ঞতা খারাপ হয়, তখন তাঁরা ভয় পেয়ে যান। তাই ভবিষ্যতে আর এই খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী থাকেন না।’
শেয়ারবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করলেও স্টার্টআপ খাতে দেশীয় বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে এই খাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা বাড়ানোর সুবিধা দিলেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের কৌশল, টার্ম শিট, ইকুইটি ডাইলিউশন ইত্যাদি বিষয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো গেলে দেশি ও বিদেশি দুই ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে বলে মত দেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ এডভোকেট হায়দার , প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাতিসংঘ (U.N ) তালিকাভূক্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কম্বাইন্ড ল রাইটস ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ।
প্রধান কার্যালয় : গাজীপুর জজকোর্ট সংলগ্ন এফ ১০২/১৫ হাক্কানী হাউজিং সোসাইটি,গাজীপুর, ঢাকা। মোবাইল নম্বর : 01701 331047
www.gormilnews.com