প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর, আলোচনায় ঐকমত্য হয়নি


এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন—সংবিধানে এমন বিধান যুক্ত করার বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশির ভাগ দল একমত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ তিনটি দলের আপত্তি থাকায় এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক হলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ঐকমত্য হয়নি। বিষয় দুটি নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
গতকাল রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বৈঠকের পঞ্চম দিনে এ দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে আলোচনা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মতো মধ্যাহ্নবিরতি দিয়ে আলোচনা চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। ধারাবাহিক এ আলোচনায় ৩০টি দল অংশ নিচ্ছে। আজ সোমবার ও আগামীকাল আলোচনা মুলতবি থাকবে।
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। গত বৃহস্পতিবার ঐকমত্য কমিশনে প্রস্তাবটি নিয়ে কিছু সময় আলোচনার পর তা মুলতবি করা হয়।
গতকাল সকালে এ নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়। দুই পূর্ণ ‘মেয়াদ’ হবে নাকি দুই ‘বার’ হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হয়। কেউ কেউ সংসদের দুই মেয়াদের পক্ষে, কেউ কেউ দুবারের (মেয়াদ যত দিন হোক সর্বোচ্চ দুবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে পারবেন) পক্ষে মত দেন।
যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এভাবে ঐকমত্যে আসা হয়তো সম্ভব হবে না। এর বদলে একজন সর্বোচ্চ কত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, তা ভেবে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
পরে ঐকমত্য কমিশন বিষয়টি নিয়ে দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য সময় দিয়ে বিরতি দেয়। বিরতিতে দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে এবং অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে ভাগ ভাগ হয়ে আলোচনা করেন। বিরতি শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বৈঠকে বলেন, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এ বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।
পরে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, মেয়াদ বা বারের বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, এমনটা বলার ক্ষেত্রে কারও আপত্তি আছে কি না। তখন বিএনপি, এনডিএম ও বাংলাদেশ এলডিপি এ বিষয়ে দ্বিমত জানায়।
ভিন্নমত তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, একটি পপুলার মতামত এসেছে ১০ বছর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের সঙ্গে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), সংসদের উচ্চকক্ষ গঠিত হলে তার কাজ কী হবে, এসব বিষয় সম্পর্কিত। এগুলো একসঙ্গে প্যাকেজ আকারে আলোচনা করা উচিত। এ রকম হলে তিনি হয়তো দলের একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আসতে পারবেন।
একপর্যায়ে আলী রীয়াজ বলেন, তিনটি দলের পক্ষে আপত্তি করা হয়েছে। প্যাকেজ আকারে আলোচনা হলে আলোচনা ‘কলাপস’ করার আশঙ্কা আছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, এ বিষয়ে বড় ধরনের ঐকমত্য আছে। তিনটি দল ছাড়া বাকিরা একমত। এ বিষয়ে লিখিত ঐকমত্যে যাওয়া যায় কি না, তা বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ জাসদের নেতা মুশতাক হোসেন বলেন, ৭০ ধারার ক্ষেত্রে বিএনপি যেভাবে একটি নোট দিয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও নোট দিতে পারে। কিন্তু পরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, এনসিসি, উচ্চকক্ষ এগুলো সম্পর্কিত বিষয়। এগুলো নিয়ে দলে একসঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাতে চান তিনি।
এ বিষয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত কোনো ঐকমত্য হয়নি। কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে আলোচনা মুলতবি করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
আলোচনা শেষে বিকেলে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বৈঠকের অগ্রগতি তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ও সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি—এ দুটো বিষয় আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমরা সুস্পষ্ট এক জায়গায় এসেছি। একজন ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, এ রকম একটি জায়গায় আসার পর আমরা এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি। আলোচনার পরে তিনটি দল ভিন্নমত পোষণ করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছে। তারা তাদের নির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করে আবার আলোচনার কথা বলেছে।’
মূলনীতি
সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবে মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে। তবে বিদ্যমান মূলনীতি অক্ষুণ্ন থাকবে কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেনি কমিশন।
গতকালের আলোচনায় মূলনীতি প্রশ্নে দলগুলো মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। বামপন্থী দলগুলো বিদ্যমান চার মূলনীতি অক্ষুণ্ন রেখে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার যুক্ত করার পক্ষে। বাকি দলগুলোর বেশির ভাগ বিদ্যমান চার মূলনীতি বাদ দিয়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিস্থাপন করার পক্ষে। আর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রস্তাব হলো মূলনীতিতে ‘মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ও যুক্ত করা হোক। তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরে।
এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ আলোচনায় বলেন, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে মূলনীতি ঠিক করা হয়েছিল, তাঁরা তার পক্ষে। এর সঙ্গে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার যুক্ত করতে তাঁদের আপত্তি নেই।
বিদ্যমান মূলনীতির বিপক্ষে জামায়াতে ইসলামী। তারা সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিস্থাপনের পক্ষে মত দেয়। দলের অবস্থান তুলে ধরে জামায়াতে ইসলামীর নেতা হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, তাঁরা জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ এটিও রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ও সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করার পক্ষে।
বিদ্যমান সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ আখ্যা দিয়ে এনসিপির জাবেদ রাসিন বলেন, এই চার মূলনীতি রেখে আলোচনা চলতে পারে না।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সংবিধান অর্জিত হয়েছে। এই সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দিয়ে এখন অন্য কিছু গ্রহণ করা ঠিক হবে না। আলোচনার একপর্যায়ে বিষয়টি পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, এমন মতও আসে।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, যারা ক্ষমতায় যাবে তারা ঠিক করবে, এমন হলে ঐকমত্য কমিশনের কোনো প্রয়োজন থাকে না। এ ক্ষেত্রে বরং গণভোটই একটি উপায় হতে পারে।
আলোচনা শেষে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও সেই সময়ের ঘোষণাপত্র। সেই ঘোষণায় সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। সেটাই ছিল প্রথম সংবিধানের মূল ভিত্তি। এই মূল্যবোধ সামনে রেখে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
দুপুরের বিরতিতে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেকগুলো বিষয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একমত হচ্ছি আমরা। কিন্তু এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। এভাবে চলতে থাকলে কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না।’
আলোচনা শেষে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, বিভিন্ন দলের অনুভূতি ও অবস্থান বিবেচনা করে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাব হাজির করা হবে।
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আলোচনা সঞ্চালনা করেন।