অলস সময় কাটছে পরিচালকদের, চলচ্চিত্রের আকাশে কালো মেঘ
প্রযুক্তির নানামাত্রিক উদ্ভাবনে বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশলে আমূল পরিবর্তন এসেছে। চিত্রনাট্য, কাহিনির বিন্যাস, ক্যামেরার ব্যবহার, সম্পাদনার ধরন, দর্শক রুচি ইত্যাদিও পাল্টে গেছে। আবার একসময় মানুষ অভ্যস্ত ছিল হলে গিয়ে ছবি দেখতে। প্রযুক্তির প্রসারে বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফরমে ছবি মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
এমন কোনো ছবি নেই যেটি পাওয়া যায় না ইউটিউবে। ফলে অনেক দর্শক বর্তমানে ঘরে বসেই দেখে নিচ্ছে নিজের পছন্দের ছবিটি। রুচির সঙ্গে মিললে, অভিনব গল্পের খোঁজ পেলে হলে গিয়েও দেখছে প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা পরিচালকের ছবি। অন্যদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাম্প্রতিকতম কলাকৌশলে পিছিয়ে পড়ায় অনেক পরিচালক বেকারও হয়ে পড়ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির স্থায়ী সদস্যের সংখ্যা ৩৯৫। আর অস্থায়ী সদস্য ১৫০ জন। সব মিলিয়ে দেশে তালিকাভুক্ত পরিচালকের সংখ্যা ৫৪৫। এর মধ্যে উল্লিখিত কারণে চার শতাধিক পরিচালক বর্তমানে বেকার।
১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। বর্তমানে সংগঠনটির আজীবন সদস্য রয়েছেন ১৯ জন। আর খ্যাতিমান সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, কাজী হায়াৎ, মনতাজুর রহমান আকবর, শাহ আলম কিরন, মতিন রহমান, বাদল খন্দকার, শওকত জামিল, ছটকু আহমেদ, এফ আই মানিক, হাফিজ উদ্দিন, শাহাদত হোসেন লিটন, বদিউল আলম খোকন, মোহাম্মদ হোসেন, উত্তম আকাশের মতো পরিচালক। একদা রুপালি জগৎ মাতিয়ে রাখা নামকরা এসব পরিচালক বর্তমানে বেকার।
তাঁরা বলছেন, চলচ্চিত্রের এই পরিণতির পেছনে রয়েছে প্রযুক্তির রূপান্তরের সঙ্গে এই পরিচালকদের নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে না পারা।
এ ছাড়া পেশাদার প্রযোজক না থাকা, পছন্দের নায়ক-নায়িকার শিডিউল না পাওয়া, সর্বোপরি তাঁদের নির্মিত সিনেমার দর্শক কমে যাওয়া। বিশ্বমানের সংগীত পরিচালক, নৃত্য পরিচালক, ফাইট ডিরেক্টর ও ক্যামেরাম্যানের সংকটও রয়েছে। ফলে বর্তমানে তাঁরা এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশ স্বাধীনের আগের বছর ১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল ৪২টি ছবি, সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০০৫ সালে ছবি মুক্তির এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০। অথচ ১৮ বছর পর ২০২৩ সালে মুক্তি পায় মাত্র ২২টি ছবি। পরিসংখ্যানের এই তারতম্য থেকেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটি চিত্র পাওয়া যায়।
চলচ্চিত্রের চাঙ্গাভাবে একসময় উচ্চশিক্ষিতরা চাকরির পেছনে না ছুটে চলচ্চিত্রে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে চাইতেন। নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্রে যুক্ত হওয়া তরুণরা বর্তমানে মধ্যবয়সী। সবারই রয়েছে সংসার। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জীবনধারণের খরচও দিন দিন ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। অথচ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই পর্যায়ে তাঁরা হয়ে পড়েছেন বেকার। এঁদের অনেকে অসুস্থ হলেও অর্থাভাবে করাতে পারছেন না চিকিৎসা। যথাযথ চিকিৎসা করাতে না পেরে একজন পরিচালক অন্ধ হয়ে গেছেন। কেউ বা পরিবার থেকে হয়ে পড়েছেন বিচ্ছিন্ন। অনেকে ফিরে গেছেন গ্রামে। কেউ পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। আবার কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে নামকরা বেশ কয়েকজন পরিচালকও রয়েছেন। পরিচালক কাজী হায়ােক চিকিৎসার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহায়তার আবেদন করতে হয়েছিল।
‘পেটে ক্ষুধা মুখে লাজ’ নিয়েই চলছে এই পরিচালকদের জীবন। অনেকটা মানবেতর জীবন যাপন করলেও কাউকে তা বলতে চান না তাঁরা। এই পরিচালকদের মধ্যে বর্তমানে আট থেকে ১০ জন ছবি নির্মাণে যুক্ত থাকলেও বেশির ভাগ পরিচালক সমিতিতে বসে অলস সময় কাটান।
‘চাকর’, ‘কুলি’, ‘শান্ত কেন মাস্তান’, ‘কুখ্যাত খুনী’, ‘মাস্তানের উপর মাস্তান’—এসব ব্যবসাসফল ছবির পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর। ১৯৮০ সালে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ১৯৯১ সালে ‘ন্যায়যুদ্ধ’ সিনেমা পরিচালনার মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি পরিচালনা করেন ৪৬টি ছবি। বর্তমানে তিনিও বেকার।
পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর জানান, বেকার জীবন থেকে রেহাই পেতে গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন তিনি। সেখানেও লোকসান হওয়ায় ব্যবসাটি গুটিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে আর কিছুই করছেন না তিনি। সময় কাটাতে এফডিসিতে যাওয়া-আসা করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘মাস্তানের উপর মাস্তান’ ছবি পরিচালনার জন্য তিনি আট লাখ টাকা সম্মানী নিয়েছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের অবস্থা এত খারাপ যে দুই বছর আগে দুটি ছবি পরিচালনা করে তিনি নামমাত্র সম্মানি পেয়েছিলেন।
দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ছবি দেখতে একসময় দর্শকরা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। বর্তমানে তিনিও বেকার। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, গত ১০ থেকে ১২ বছরে বেকার থেকে কোনো কোনো পরিচালক অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে পারছেন না। তেমনই একজন পরিচালক এম এ আউয়াল। ‘রাজপথের বাদশা’ ও ‘কাছের শত্রু’ সিনেমা পরিচালনা করে নাম করেছিলেন তিনি। পরে তিনি বেকার হয়ে যান। এক পর্যায়ে পরিবার থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। গত মে মাসে এক রাতে তাঁর লাশ উদ্ধার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল না।
‘নছিমন’ ও ‘ময়নামতির সংসার’ ছবি পরিচালনা করেন আলী আযাদ। আগে চলচ্চিত্রের কাহিনিকার হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। সেই আলী আযাদ বর্তমানে অন্ধ। অর্থসংকটে চোখের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। আত্মীয়দের সহায়তায় বেঁচে আছেন তিনি। গুণী এই কাহিনিকার ও পরিচালক লোকলজ্জায় কারো কাছে সহায়তা চাইতে পারছেন না।
আলী আযাদ বলেন, ‘অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। আগের মতো কেউ খোঁজখবরও রাখে না। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমার বাকি জীবনটা একটু ভালো কাটতে পারত।’
কাজ না থাকায় টানাটানি করে সংসার চালাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ‘প্রেমের তাজমহল’ খ্যাত পরিচালক গাজী মাহবুব। তিনি জানান, একসময় তিনি নিজেকে রাজা মনে করতেন। কিন্তু বেকার থাকতে থাকতে এখন হতাশ তিনি। ইউটিউব চ্যানেল ও বিজ্ঞাপন করে কিছু আয় হয়। তা দিয়ে কোনোমতে স্ত্রী ও তিন সন্তানের পরিবার চলে।
পরিচালক জ্যাম্বস কাজল। ১৯৯৪ সালে একবুক স্বপ্ন নিয়ে বগুড়ার শেরপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ‘মা আমার বেহেশত’ নামের একটি ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে শুরুতেই হোঁচট খান তিনি। প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্নাকে ঠিক করেছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। মাস ছয়েক ঘুরিয়ে তিনি আর কাজটি করেননি। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয় নতুন এই পরিচালকের। পরে ছবিটির নায়ক হন অমিত হাসান। কিন্তু ছবিটি ব্যবসাসফল না হওয়ায় তিনি আর দাঁড়াতে পারেননি। বর্তমানে ‘অবক্ষয়’ নামের একটি ছবি বানাচ্ছেন। এর জন্য ১৫ লাখ টাকা ঋণ করেছেন। জ্যাম্বস কাজল বলেন, ‘আমাদের অনেক পরিচালক ভূমিহীন। সরকারের কাছে আমরা ভূমির জন্য আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
পরিসংখ্যান যা বলছে : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ছবি মুক্তি পেয়েছে ২২টি, ২০২২ সালে ১৬টি, ২০২১ সালে ১৩টি, ২০২০ সালে ১৪টি, ২০১৯ সালে ১১টি, ২০১৮ সালে ২৫টি, ২০১৭ সালে ২৩টি, ২০১৬ সালে ৩২টি, ২০১৫ সালে ৩৩টি, ২০১৪ সালে ৩৯টি, ২০১৩ সালে ২৩টি, ২০১২ সালে ৪০টি, ২০১১ সালে ৪৫টি, ২০১০ সালে ৫৩টি, ২০০৯ সালে ৬৩টি, ২০০৮ সালে ৬৪টি, ২০০৭ সালে ৯৬টি, ২০০৬ সালে ৯৬টি, ২০০৫ সালে ১০০টি, ২০০৪ সালে ৮৮টি, ২০০৩ সালে ৭৯টি, ২০০২ সালে ৮২টি, ২০০১ সালে ৭২টি এবং ২০০০ সালে মুক্তি পায় ৮৮টি চলচ্চিত্র। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পায় আবদুল জব্বার খান পরিচালিত এই অঞ্চলের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। পরের তিন বছর কোনো ছবি মুক্তি না পেলেও ১৯৫৯ সালে তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ১৯৭০ সালে দেশে ৪২টি ছবি মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছিল সাতটি সিনেমা। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশেও মুক্তি পেয়েছিল ৩০টি চলচ্চিত্র। ১৯৮০ সালে মুক্তি পায় ৪৭টি সিনেমা। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পায় ৫৭টি, ১৯৯০ সালে মুক্তি পায় ৭০টি সিনেমা।