ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি যেভাবে হলো

0
gyujgytj

চার রাত দুই দেশের মধ্যে দোষ চাপানোর খেলা চলল। ভারত আর পাকিস্তানের বড় বড় শহরের আকাশ দিয়ে পাল্টাপাল্টি উড়ে গেল মিসাইল আর ড্রোন। মনে হচ্ছিল পারমাণবিক অস্ত্রধর প্রতিবেশী দুই দেশ বোধ হয় সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেই গেল! এরপর হঠাৎ করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করলেন।

শনিবার ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প পোস্ট করলেন, ‘ভারত আর পাকিস্তান সম্পূর্ণ আর তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।’ তিনি জানান যে সিদ্ধান্তে আসতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাতব্যাপী দীর্ঘ আলোচনা’ করতে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির এই হঠাৎ ঘোষণার আগে চার দিন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলছিল। যুক্তরাষ্ট্র এখানে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না মধ্যস্থতায়, তা নিয়ে ধোঁয়াশা বজায় ছিল।

শনিবার ভারত ও পাকিস্তানে যখন স্বস্তির আবহ চলছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র তৃপ্ত ছিল আত্মতুষ্টি নিয়ে। কিন্তু কাশ্মীর আরও এক সহিংসতার রাত কাটাল। দুই দেশই যুদ্ধবিরতির পরপরই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। আসলে এটাই বাস্তবতা। এই যুদ্ধবিরতি বোধ হয় এক সাময়িক স্বস্তি। স্থায়ী কিছু নয়।

শুক্রবার ওয়াশিংটনের সময় দুপুর নাগাদ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিতে। ভ্যান্স মোদিকে একটি সম্ভাব্য ‘প্রস্থান পথ’ প্রস্তাব করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আশা করছিলেন যে পাকিস্তানিরাও এই ঝামেলা থেকে বের হয়ে আসতে সম্মত হবে। পরবর্তী ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা উভয় দেশের সমকক্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ চালিয়ে যান।

একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, পররাষ্ট্রসচিব মার্কো রুবিও শুক্রবার রাতের বেশির ভাগ সময় ভারত ও পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটানা যোগাযোগ রেখে চুক্তিটি চূড়ান্ত করেন। ‘আমরা প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শরিফের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তের প্রশংসা করি, কারণ তাঁরা শান্তির পথ বেছে নিয়েছেন।’ শনিবার এক্সে (টুইটারের নতুন নাম) এক পোস্টে লেখেন রুবিও। তিনি যোগ করেন, এই উদ্যোগে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্সের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। এর ঠিক আগের দিনই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা একপ্রকার নাকচ করে দিয়েছিলেন। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেছিলেন, ‘আমরা এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছি না, যা মূলত আমাদের ব্যাপারই নয় এবং যার ওপর আমেরিকার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ তিনি সেই সঙ্গে আরও বলেছিলেন, ‘আমরা এসব দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না।’

দুই দেশ পরস্পরের দিকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। রুবিও তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে কথা বলেন। রুবিওর সঙ্গে মুনিরের এই কথোপকথন এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রেখেছে।
শনিবার ইসলামাবাদ দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার স্বীকৃতি দেয়। এক পাকিস্তানি কর্মকর্তা বলেন, এই চুক্তির ভিত্তি ছিল দুটি প্রধান বিষয়—এক, গুরুতর যুদ্ধবিস্তার বা সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, এবং দুই, হোয়াইট হাউস প্রশাসনের হস্তক্ষেপ, অর্থাৎ বাইরের চাপে সমাধান।’

পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মঈদ ডব্লিউ ইউসুফ এক্সে লিখেছেন, ‘উত্তেজনা প্রশমন শেষ পর্যন্ত পুরোনো ছক অনুযায়ীই হয়েছে—তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা, যার নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।’

তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা এই প্রসঙ্গে অনেকটাই নিশ্চুপ ছিলেন। নয়াদিল্লির কয়েকজন বিশ্লেষক প্রকাশ্যে রুবিওর বক্তব্য নিয়ে আপত্তি জানান। রুবিও বলেছিলেন যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ‘খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা’তে রাজি হয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা এই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কারগিল যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান এবং ভারত–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন।

ইউক্রেন আর গাজায় যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ট্রাম্প ব্যর্থ হয়েছেন। সেই হিসেবে যত ঝামেলাই থাকুক, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই যুদ্ধবিরতি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য এক বিজয় তাতে সন্দেহ নেই। বৃহস্পতিবার রুবিও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে কথা বলেন। এরপরই এই কূটনৈতিক উদ্যোগ গতি লাভ করে।

এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে তখন উত্তেজনা বাড়ছিল। দুই দেশ পরস্পরের দিকে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। রুবিও তখন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে কথা বলেন। রুবিওর সঙ্গে মুনিরের এই কথোপকথন এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রেখেছে।

সেদিনই পরে রুবিও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে কথা বলেন। দার পরে জিও নিউজকে বলেছেন যে রুবিও তাঁকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে বলেন, কারণ ‘দুই দেশই পরমাণু অস্ত্রের মালিক। পৃথিবী এটা সমর্থন করবে না।’ দার তখন রুবিওকে বলেন, ‘বল এখন ভারতের কোর্টে।’ রুবিও এরপর জয়শঙ্করকে ফোন করেন।

ঘণ্টাখানেক পর, বেলা সাড়ে তিনটায় পাকিস্তানের মিলিটারি অপারেশনসের ডিরেক্টর জেনারেল ফোন করেন ভারতের একই পদে থাকা ব্যক্তিকে। এই কথা জানিয়েছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। তবে এই যোগাযোগ পাকিস্তান শুরু করেছে, তা মানতে রাজি নন পাকিস্তানি একজন কর্মকর্তা।

যা হোক, শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ বিকেল ৫টা থেকে ভূমি, বায়ু ও জলপথে সব রকম গোলাগুলি ও সামরিক কার্যক্রম বন্ধে রাজি হন। এ কথা জানা গেছে মিশ্রির বয়ানে।
তবে যুদ্ধবিরতির এই ক্ষণিকের সুযোগটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির সম্ভাবনার জন্ম দেওয়ার আশা দ্রুতই ভেঙে পড়ল।

শনিবার সন্ধ্যায় ভারতীয় গণমাধ্যমে এক সরকারি বিবৃতি ছড়িয়ে পড়ে। টেলিভিশন উপস্থাপকরা হুবহু তা পড়ে শোনান—‘ভারত ঘোষণা করছে, ভবিষ্যতে যেকোনো সন্ত্রাসী হামলাকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি জানান, ভারত তার ‘যুদ্ধনীতি পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে’ এবং যদি আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে ভারত ‘আরও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খোলা রাখছে।

এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত ও পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিভাজক রেখার আশপাশে বিস্ফোরণের শব্দ ও ড্রোনের গুঞ্জন শোনা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। নয়াদিল্লি অভিযোগ তোলে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। তবে ইসলামাবাদ দৃঢ়ভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।

ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রোগ্রামের নন–রেসিডেন্ট ফেলো ক্রিস্টোফার ক্ল্যারির মতে, ‘আমরা হয়তো এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করছি। এর সঙ্গে গত তিন দশকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যে অবস্থায় আছে তার মিল আছে।’ ক্ল্যারির কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে এর মানে, ভবিষ্যতেও ভারত আর পাকিস্তানের মাঝে অনবরত হামলা ও পাল্টা হামলা চলতেই থাকবে।

কারিশমা মেহরোত্রা ওয়াশিংটন পোস্টের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা
রিক নোয়াক ওয়াশিংটন পোস্টের আফগানিস্তান ব্যুরো প্রধান
নাটালি এলিসন ওয়াশিংটন পোস্টের হোয়াইট হাউস প্রতিনিধি
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *